সম্প্রতি অনেক জল্পনা কল্পনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রের সুপারপাওয়ার হিসেবে, নির্বাচনটি প্রতিবারই শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব ফেলে। কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করে এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসায় দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা সেটি এখন সময়োপযোগী প্রশ্ন।
অন্যদিকে বাংলাদেশকে বরাবরই দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি ভারত- চীনের চোখ দিয়ে দেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যদিও জো বাইডেনের শাসনামলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে প্রশ্ন হলো,এবার ট্রাম্পের শাসনামলে এই সম্পর্কের গতিমাত্রা কেমন হবে? যেখানে বাংলাদেশের শাসনামলেও ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বর্তমানে রয়েছেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস, যার সাথে আমরা অতীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্কের ইতিবাচক দিক কমই পরিলক্ষিত করেছি।
ইতিমধ্যেই অনেক বিশ্লেষক বিষয়টির আলোচনা করেছেন বিভিন্নভাবে। তবে আমরা যদি এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে চাই তাহলে ট্রাম্পের প্রথম শাসনকালের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি, যা কিনা ২০১৭-২০২০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। বলা হয়, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারনার সময় মোহাম্মদ ইউনূস ছিলেন ঘোরতর ট্রাম্প বিরোধী। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল ইউনূস ট্রাম্প বিরোধী প্রচারণা কাজে অনুদান দিয়েছিলেন। সে বার জেতার পর ট্রাম্প বলেছিলেন “Where is the micro finance guy from Dhaka?” এবারও নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে অবস্থিত সংখ্যালঘু হিন্দু খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচারের নিন্দা করে টুইট করেন ট্রাম্প।
এছাড়াও ইউনূস ২০১৭ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়কে “সূর্যগ্রহণ” বা অন্ধকার সময় হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাই এবারে ট্রাম্পের জয়কে ইউনূস সরকারের বিরোধীরা তার জন্য অস্বস্তিকর হিসেবে দেখছেন, যদিও নির্বাচনের ফলাফলের পর মোহাম্মদ ইউনূস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এছাড়াও বলা হয় মোহাম্মদ ইউনূসের সাথে ডেমোক্র্যাটদের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে,যা কিনা রিপাবলিকানদের সাথে দেখা যায়না। তবে এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন যে শুধু ডেমোক্র্যাট নয় রিপাবলিকানদের সাথেও মোহাম্মদ ইউনূসের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তার মতে, ট্রাম্পের শাসনামলে বাংলাদেশ আরো উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাবে।
তবে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক। রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারতের মোদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত। আর এই বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। কেননা, সম্প্রতি জুলাই আন্দোলনের ফলে ভারতের বন্ধুদল আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের ছায়ায় রয়েছেন। স্বভাবতই ভারত সরকার চাইবে বাংলাদেশে তার মিত্র দলের ক্ষমতা পুনর্বহাল হোক,শেখ হাসিনা পুনরায় বাংলাদেশ শাসন করুক। আর এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এর জন্য কতটা হুমকিস্বরুপ তা বিশ্লেষকরা ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছেন। আর তাই বলা যায় যে, মোদী ট্রাম্পের সাথে বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ইউনূস সরকারের পতনের জন্য কাজ করতে পারে।
কিন্তু আবার একথাও মনে রাখা জরুরি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প খুবই ট্রানজেকশনাল মানুষ। তিনি “Give and Take” এ বিশ্বাসী। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, নির্বাচনের সময় ট্রাম্প বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইট করে মূলত হিন্দুদের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করেছেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে যাওয়ার পরে ট্রাম্প মোদীর সাথে ভারতের সম্পর্ক এবং শেখ হাসিনা সরকারের পুনর্বহাল নিয়ে ট্রাম্প মাথা ঘামাবেন কিনা এই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা,ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির সাথে এটি যায়না। ট্রাম্প সবসময়ই নিজ দেশ সম্পর্কেই বেশি ভেবেছেন। বাহিরে যুদ্ধ সংঘাত করতে সবসময়ই অনুৎসাহী ছিলেন। তিনি আমেরিকার “Superpower Ability” কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সেদিকেই সবসময় মনোনিবেশ করেছেন। যে কারণে তিনি ন্যাটোতে তার বাজেট পর্যন্তও কমিয়ে নিয়ে এসেছিলেন পূর্বের শাসনকালে। তাই বিশ্লেষকরা মনে করছেন ট্রাম্পের শাসনকালে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের তেমন কোনো পরিবর্তন হবেনা।
তবে আমরা ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি নিয়ে কিছুটা শংকিত হতে পারি। কেননা,ট্রাম্প তার প্রথম শাসনামলে অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য কঠিন নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যদিও ট্রাম্প তখন তার এই নীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হননি,এবার তিনি পুনরায় এই নীতি গ্রহণ করতে পারেন, যদিও এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একইসাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এই নীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা অনেক এবং তাদের মাধ্যমে বাংলাদশ রেমিটেন্স অর্জন করছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের ১৬ ভাগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশীদের থেকে।
আরও পড়ুনঃ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডিপ্লোম্যাট’স পডিয়াম ১.০’ প্রতিযোগিতার ফাইনাল অনুষ্ঠিত
এছাড়াও রোহিঙ্গা ইসুতে ট্রাম্প শাসনামলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। পূর্বে জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পেতো বাংলাদেশ। ট্রাম্পের “America First” নীতির কারণে ট্রাম্প শাসনামলে এই সাহায্যের পরিমাণ কমে আসতে পারে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্কের সমীকরণ বাংলাদেশকে লাভবান করতে পারে। কারণ, চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিষয়ে বিরোধ বরাবরই ছিল। ট্রাম্প শাসনামলে এটির তেমন পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়না। তাই বাংলাদেশ এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দেশের গার্মেন্টস খাত উন্মুক্ত করে দিতে পারে। এতে চীনের বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিবেচনা করবে। এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ট্রাম্প হয়তো প্রথমেই বাংলাদশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করবেনা। ট্রাম্পের প্রথম কাজ হবে গাজা-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব, ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করা।
আর বাংলাদেশও ট্রাম্পের জয়কে ইতিবাচক ভাবে দেখতে পারে। বাংলাদেশ যদি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রকিয়া অনুসরণ করে, সৃজনশীল ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি তৈরি করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপযুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারে, বহির্বিশ্বের সাথে একটি দ্বন্দ্ববিহীন কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে, তাহলেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হবে। এমনকি এই প্রত্যাশাও করা যায় যে, ট্রাম্পও ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদশকে না দেখে একক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবেই বাংলাদেশকে বিবেচনা করবে।
লেখক: তাহমিনা আক্তার
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়