spot_img

― Advertisement ―

spot_img
প্রচ্ছদইসলাম ও জীবন ব্যবস্থাআশুরা: ইতিহাস, তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি

আশুরা: ইতিহাস, তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি

আশুরা কী?

আশুরা (আরবি: عاشوراء) হলো হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররমের ১০ তারিখ। এটি ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আবেগঘন একটি দিন। মুসলিম উম্মাহর কাছে এই দিনটি শোক, আত্মত্যাগ, শিক্ষা ও আত্মজিজ্ঞাসার প্রতীক। বিশেষ করে শিয়া মুসলমানদের কাছে দিনটি অত্যন্ত শোকাবহ, কারণ এই দিনে কারবালার প্রান্তরে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার পরিবারবর্গ শহীদ হন। তবে শুধু শোক নয়, এই দিনটি মুসলিমদের জন্য আত্মশুদ্ধি ও আদর্শিক সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।

ঐতিহাসিক পটভূমি

৬১ হিজরি সনের ১০ মুহাররম (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ), বর্তমান ইরাকের কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজনসহ শাহাদাত বরণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন পরিবারের সদস্য, সহচর এবং অল্প কয়েকজন অনুসারী। কারবালার প্রান্তরে এই আত্মত্যাগ ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা।

ইমাম হোসাইন (রা.)-এর এই আত্মোৎসর্গ মুসলিম সমাজে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চিরন্তন বার্তা ছড়িয়ে দেয়। তিনি শক্তিশালী হলেও নীতিবোধের কারণে স্বৈরশাসক ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণ করেননি, বরং শহীদ হয়ে ইসলামের মহান মূল্যবোধ রক্ষার ইতিহাস রচনা করেন। এই ঘটনা মুসলিমদের মধ্যে নৈতিকতা, সাহসিকতা এবং ত্যাগের শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত।

ইসলামপূর্ব ঐতিহাসিক গুরুত্ব

আশুরা শুধু কারবালার স্মরণেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামপূর্ব যুগেও এই দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন হাদিস ও ইতিহাস অনুযায়ী, এই দিনে:

  • নবী নূহ (আ.)-এর নৌকা তুফান থেকে রক্ষা পেয়ে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে,
  • নবী মূসা (আ.) ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি পান এবং বনি ইসরাইল রক্ষা পায়,
  • নবী ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান,
  • নবী ইব্রাহিম (আ.) আগুন থেকে রক্ষা পান।

রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে জানতে পারেন যে, ইহুদিরা এ দিন রোজা রাখে। কারণ, এ দিনে মূসা (আ.)-কে আল্লাহ ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তখন তিনি বলেন, “আমরা মূসার প্রতি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার,” এবং এ দিনে রোজা রাখেন ও সাহাবাদের রোজা রাখতে বলেন। পরবর্তীতে রমজান মাসকে ফরজ রোজা হিসেবে নির্ধারণ করা হলে আশুরার রোজা সুন্নত হিসেবে থেকে যায়। পাশাপাশি তিনি বলেন, “তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে একদিন আগে বা পরে রোজা রাখো যেন ইহুদিদের সাথে মিল না হয়।”

বিশ্বব্যাপী আশুরা পালনের ধারা

আশুরা মুসলিম বিশ্বে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি, ইতিহাসচেতনা এবং আচারভিত্তিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

  • শিয়া মুসলমানদের কাছে: কারবালার শোকাবহ স্মৃতিকে কেন্দ্র করে তাজিয়া, মাতম, শোক মিছিল, মার্সিয়া পাঠ, নিজ শরীরে আঘাত করা প্রভৃতি আচার পালিত হয়। কারবালার ঘটনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইমাম হোসাইনের আত্মত্যাগ স্মরণে নানা নাটকীয় আয়োজন হয়।
  • সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে: আত্মশুদ্ধি, ইবাদত, রোজা পালন, দোয়া ও দান-সদকা মাধ্যমে দিনটি পালন করা হয়। শোক বা মাতমের পরিবর্তে আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
  • বাংলাদেশে আশুরা: প্রাচীন ঢাকায় মহররম উপলক্ষে হোসেনি দালান কেন্দ্রীক তাজিয়া মিছিল, আলম, জুলজানার বাহন, পানির কুম, মার্সিয়া ও নওহা পাঠের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয়। অন্যান্য স্থানেও ধর্মীয় পরিবেশ বজায় রেখে আশুরার নানা অনুষ্ঠান পালিত হয়।

আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা

আশুরা শুধু অতীতের একটি ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য নয়, বরং এটি একটি শিক্ষার দিন। কারবালার ঘটনা মুসলিমদের মধ্যে কিছু মৌলিক মূল্যবোধের চর্চা জাগিয়ে তোলে:

  • ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান: ইমাম হোসাইনের জীবন আমাদের শেখায় কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়।
  • আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত: তিনি নিজে ও পরিবারবর্গ নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন ইসলামের সঠিক আদর্শের জন্য।
  • ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা: কঠিনতম মুহূর্তেও তিনি সাহস ও ধৈর্য ধরে রেখেছেন।
  • অহিংস প্রতিবাদ ও আদর্শচিন্তা: অস্ত্রের কাছে মাথা নত না করে নৈতিকতার শক্তিতে তিনি সংগ্রাম করেছেন।

আরও পড়ুনঃ কুরবানির গরু কেমন হতে হবে? ইসলাম কী বলে?

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আশুরা

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে, যেখানে বৈষম্য, দুর্নীতি, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ক্রমাগত বাড়ছে, সেখানে আশুরার শিক্ষা আমাদের জন্য আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক দায়িত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নৈতিকতা ও সাহসিকতা অপরিহার্য। কারবালার শিক্ষা শুধুমাত্র ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একটি নৈতিক দর্শন—যা আমাদের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রজীবনে আলোর পথ দেখাতে পারে।

বিশ্বজুড়ে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ, দমন-পীড়নের পরিস্থিতিতে আশুরা আমাদের অনুপ্রাণিত করে নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াতে, ন্যায়ের পক্ষে সাহসী হতে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। সামাজিক বিভাজন, ধর্মীয় সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করতে আশুরার বার্তা আজও সমানভাবে জরুরি।

আশুরা কেবল শোক বা ঐতিহাসিক স্মরণ নয়, এটি একটি আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ আমাদের সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার শিক্ষা দেয়। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যেকোনো সময়েই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই প্রকৃত ইসলামী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ইসলাম কেবল ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ন্যায় ও আদর্শের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করাও এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আশুরা আমাদের আহ্বান জানায়—ভয় নয়, বরং আদর্শের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। এটি এমন একটি চেতনাদায়ী দিন, যা যুগে যুগে মুসলিম সমাজকে নৈতিক শক্তি ও সাহসিকতার বার্তা দিয়ে এসেছে। তাই আশুরা শুধু অতীত নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশকও।