
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর চলমান দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার ১৯তম দিনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও কিছু বিষয়ে এখনো মতভেদ রয়ে গেছে।
রোববার (২৭ জুলাই) অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ এবং একটি স্বাধীন ‘বাংলাদেশ পুলিশ কমিশন’ গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়। তবে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং সংসদে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের হার নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দিনশেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বাকি থাকা প্রস্তাবগুলো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে।”
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে মতানৈক্যঃ
আলোচনার সূচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। আলী রীয়াজ জানান, “এটি নিয়ে আজ চতুর্থ দিনের মতো আলোচনা হলেও এখনো কোন একমত হয়নি। কেউ কেউ বিদ্যমান চার মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) সঙ্গে নতুন কিছু যুক্ত করার প্রস্তাব দিচ্ছেন, আবার কেউ চাইছেন শুধু উল্লেখ থাকুক।” এ বিষয়ে আরও সময় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে ঐকমত্যঃ
বৃহত্তর ঐকমত্য গড়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ কমিশন’ গঠন বিষয়ে। আলী রীয়াজ বলেন, “এ কমিশনের উদ্দেশ্য হবে পুলিশের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা দেওয়া এবং পুলিশ সদস্য বা বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বিচার নিশ্চিত করা।”
তিনি জানান, ৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশন আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এবং এর চেয়ারম্যান হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারপতি। নারী সদস্য অন্তত দুজন রাখার কথাও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশন বেআইনি পুলিশি কর্মকাণ্ডে শাস্তি নির্ধারণ, প্রভাবমুক্ত তদন্ত ও প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চালানোর এখতিয়ার পাবে। কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকবে বলেও জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছরঃ
একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয় যে, কোনো ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। আলী রীয়াজ বলেন, “এটি বাস্তবায়নে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনতে হবে।” এ সিদ্ধান্তকে কমিশন নতুন যুগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখছে।
আরও পড়ুনঃ বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত বদলাতে হবে: জোনায়েদ সাকি
নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে মতানৈক্যঃ
নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কমিশন প্রস্তাব করেছে, ৫০টি সংরক্ষিত আসন বজায় রেখে সরাসরি নির্বাচনে এক–চতুর্থাংশ কিংবা এক–পঞ্চমাংশ আসনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হোক। তবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমত হয়নি বলে জানান সহসভাপতি।
আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। উপস্থিত ছিলেন সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও আইয়ুব মিয়া।
আলী রীয়াজ বলেন, “আজ রাত আটটা পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। আগামীকাল আরও দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।”
আজকের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ মোট ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই চলমান আলোচনা আগামী দিনের রাজনীতি, প্রশাসনিক কাঠামো এবং সাংবিধানিক সংস্কারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।