নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের আগ্রহ, আবেগ ও অংশগ্রহণের মাত্রা এক অনন্য সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অলিগলি—সর্বত্রই নির্বাচন ঘিরে জমে ওঠে আলোচনা, শুরু হয় প্রার্থীদের মুখে-মুখে গল্প। বছরের পর বছর জনসংযোগে অনুপস্থিত থাকা প্রার্থীরাও নির্বাচনের মৌসুমে হয়ে ওঠেন “ভালোমানুষ”; খোঁজখবর, সালাম, উপহার, ঈদ শুভেচ্ছা এমনকি পান-সিগারেট দিয়েও ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টায় থাকেন তারা।
এই নির্বাচনী সংস্কৃতির আবহে সম্প্রতি যখন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এপ্রিল মাসে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন, তখন অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে—এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কী স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত মিলল?
যদিও ড. ইউনুস সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার কমতি নেই, কারণ তার নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়ার আশা বহুজনের। তবে সমালোচনার জায়গাও রয়ে গেছে। ছাত্র জনতার পক্ষ থেকে গঠিত এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি ওঠেছে—জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এই দাবিকে উপেক্ষা করা হলে অনেকেই এটিকে গণআকাঙ্ক্ষার অবহেলা হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনটি আগে হোক। তাদের ধারণা, তারা যদি জাতীয় সংসদে দ্রুত ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে প্রশাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসা সহজ হবে। এরপর স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা হলে তা তাদের ‘নিরঙ্কুশ প্রাধান্য’ বজায় রাখার সুযোগ তৈরি করবে।
আর স্থানীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলে সিনিয়র বিএনপি নেতাদের জন্য ‘পদ বাণিজ্য’ এবং প্রার্থী মনোনয়নে আর্থিক সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা অতীতের ক্ষতি পূরণে সহায়ক হতে পারে—এমনটাই মনে করছে সচেতন নাগরিক সমাজ। সেই হিসেবে স্থানীয় নির্বাচন পেছানোর দাবিতে বিএনপির কৌশলটা অনেকটাই স্বার্থান্বেষী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অনেকেই মনে করছেন, উপজেলা, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মীরা চান আগে স্থানীয় নির্বাচন হোক। কারণ এতে তৃণমূলের মতামত ও অংশগ্রহণ সরাসরি প্রতিফলিত হবে। উপরন্তু, প্রার্থী বাছাইয়ে জনসম্পৃক্ততা ও জবাবদিহিতার একটা বাস্তব প্রক্রিয়া গড়ে উঠবে। আর স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী হলে জাতীয় রাজনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ বরাবরের মতোই সরল-সোজা, নিরীহ ও শান্তিপ্রিয়। তারা রাজনীতির মারপ্যাঁচ অনুধাবন করলেও উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করার মতো সাহস বা পরিবেশ পায় না। তবে ভোটের মাধ্যমে তারা অনেক সময় চমক দেখাতে সক্ষম হয়েছে। যেসব নেতা গরিবের পাশে থেকেছেন, দুর্দিনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছেন, তাদের জন্য জনগণ বুকের রক্ত দিতেও দ্বিধা করেনি। আবার যারা ক্ষমতার দম্ভে জনগণকে অবহেলা করেছেন, ভোটের মাঠে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্বপ্নের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি অনুচিত ও আইনবিরোধী
তাই নির্বাচনের এই নতুন প্রেক্ষাপটে জাতি একটি 'ভিন্ন কিছু' প্রত্যাশা করছে। মানুষ চায় সৎ, সাহসী ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নেতৃত্ব। প্রশ্ন এখন একটাই—আগে কি স্থানীয় নির্বাচন হওয়া উচিত, যাতে জনগণের রায় তৃণমূল থেকেই উঠে আসে? নাকি জাতীয় নির্বাচনই আগে প্রয়োজন, যেখান থেকে দেশের দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হবে?
ড. ইউনুসের সরকারকে নিয়ে যেমন আশাবাদী মানুষ, তেমনি তারা চায় স্বচ্ছ ও বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত। স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে নীরবতা, কিংবা কৌশলগত বিলম্ব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে যেন কাউকে বঞ্চিত না করে—এটাই এ মুহূর্তে সর্বজনীন প্রত্যাশা।
লেখকঃ
শেখ নজরুল ইসলাম
সাংবাদিক ও এক্টিভিস্ট