

“আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিও না এবং যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” — পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি (সুরা লোকমান ৩১:১৮) অহংকারের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে স্পষ্ট সতর্কতা দেয়। এমন আরও আয়াত পাওয়া যায় সুরা বনি ইসরাইল (১৭:৩৭) ও সুরা কাহাফ (১৮:৩৪)-এ, যেখানে অহংকার ও গর্বকে ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পবিত্র হাদিসেও এসেছে— “তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (তিরমিজি: ১৯৯৮) আর এক হাদিস কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, “ইজ্জত-সম্মান হচ্ছে আমারই পোশাক এবং গর্ব-অহংকার হচ্ছে আমারই চাদর। তাই যে ব্যক্তি এই দু'য়ের কোনোটি নিয়ে টানাটানি করবে, তাকে আমি কঠোর শাস্তি দেবো।” (আবু দাউদ: ৪০৯০)
অহংকারকে বলা হয় ‘উম্মুল আমরাজ’— অর্থাৎ সকল পাপের জননী। কারণ, এটি থেকেই জন্ম নেয় লোভ, হিংসা, প্রতারণা ও জুলুমের মতো মারাত্মক মানবিক ব্যাধি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— যেসব জাতি ও শাসক অহংকারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতেই লাঞ্ছিত করেছেন। নমরুদ, ফেরাউন কিংবা হিটলারের মতো শাসকরা এরই বাস্তব উদাহরণ। সদ্য পরাজিত শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের পতনও অহংকারেরই ফল— ইতিহাসে যা হয়ে থাকবে এক শিক্ষণীয় অধ্যায় হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই অহংকারের প্রবণতা নতুন নয়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর, মাত্র পাঁচ বছর পরই জিয়াউর রহমানও সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন। এরপর ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও রাজনীতিকদের শিক্ষা হয়নি। তাই আজ, ২০২৪ সালে, আবারও দেশের দায়িত্ব নিতে হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে— এক ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতার প্রেক্ষাপটে।
এই সময়ে জনগণ আন্দোলনে রক্ত দিয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ, আহত হয়েছে পঞ্চাশ হাজার বিপ্লবী। অথচ এই আত্মত্যাগ থেকেও রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি মনে করেছিল, তাদের হাতে ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে। কিন্তু মসজিদ-মাদরাসা থেকে শুরু করে হাট-বাজার পর্যন্ত চাঁদাবাজি ও পদবাণিজ্যের অভিযোগে বিএনপির সাংগঠনিক সুনাম এখন মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দলের অভ্যন্তরে একধরনের অরাজকতা ও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, যা জনগণের আস্থা আরও দুর্বল করছে।
আরও পড়ুনঃ ইবিতে কোরআন ও হিজাববিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি
সামাজিক মাধ্যমে এখন আলোচিত বিষয় হলো ঐক্যমত কমিশনের রিপোর্ট ও গণভোট। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলামসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবীদের দায়মুক্তি দেওয়ার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একমাত্র বিএনপি এখনো সেই প্রশ্নে অস্পষ্ট অবস্থান ধরে রেখেছে, যেন শুধুমাত্র ক্ষমতায় ফেরা তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
রাজনীতিতে আবারও অহংকার ও ক্ষমতার লালসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নতুন করে মন্ত্রীদের গাড়ি কেনা, এমপি প্রার্থীদের জন্য মামলা প্রস্তুত করা, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নাম চূড়ান্ত হয়ে গেছে— এমন খবর ঘুরছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এই অহংকার এখন জনগণের কাছে পরিণত হয়েছে তামাশায়।
এই পরিস্থিতিতে পবিত্র কোরআনের সুরা আনফালের ৩০ নম্বর আয়াত যেন এক চিরন্তন বার্তা স্মরণ করিয়ে দেয়— “আর তারা পরিকল্পনা করেছিল, আর আল্লাহও পরিকল্পনা করেছিলেন; আর আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী।” কারণ, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পরিকল্পনাই সর্বদা বিজয়ী হয়।
লেখকঃ
শেখ নজরুল ইসলাম
সাংবাদিক ও কলামিস্ট