মোঃ আব্দুল আলিম, রাজশাহী প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর মাটি, তার গন্ধ, তার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ। এই অনন্য উদ্যোগের স্রষ্টা আহসান কবির লিটন, যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির নাটক বিভাগের উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। রাজশাহীর ইতিহাসের প্রতিটি সোনালি অধ্যায় আর বাঙালির সংস্কৃতির প্রতিটি আভিজাত্যকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার এক অদম্য প্রয়াসে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
এই সংগ্রহশালায় জমা আছে সময়ের প্রতিচ্ছবি, পুরনো দিনের মিষ্টি স্মৃতি। যেন এই প্রজন্ম হাতে হাত ধরে ছুঁয়ে দেখে সেই অতীতের স্পর্শ। ঐতিহ্যের এই স্রোতধারায় নতুন প্রজন্ম যেন শিখছে কেমন ছিল রাজশাহীর গৌরব, কেমন ছিল তার প্রাণের রূপ।
রাজশাহীর শিরোইল স্কুলের পাশের একটি গলিতে দাঁড়িয়ে আছে ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ—একটি ইতিহাসের তীর্থভূমি, যেখানে জমা হয়েছে সময়ের আভিজাত্য আর মাটির গন্ধ। প্রতিষ্ঠাতা আহসান কবির লিটনের পরম মমতায় গড়া এই জাদুঘরটি যেন রাজশাহীর হৃদয়কেই মেলে ধরেছে নতুন প্রজন্মের সামনে।
আর্কাইভটির দুইতলা ভবনের আটটি ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে পুরনো দিনের নানান জিনিস, যা দেখে চমকে উঠবে আজকের তরুণ চোখ। এখানে আছে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, পুরনো দিনের ক্যামেরা, সিডি প্লেয়ার, তবলা আর এমন কত কিছু, যা আজকের সময়ে যেন বিস্ময়ের জগত। প্রতিটি জিনিস যেন গল্প বলে ১৯ শতকের জীবনধারার। আলোকচিত্রের সেই পুরনো কৌশল, আলো ব্যবস্থার সাদামাটা সৌন্দর্য—সব কিছুই এখানে জীবন্ত।
আহসান কবির লিটন নিজের সঞ্চয় ও আত্মত্যাগে গড়ে তুলেছেন এই নিদর্শন। কোন লাভের জন্য নয়; বরং সময়ের ধুলোয় ঢাকা স্মৃতিগুলো তুলে ধরেছেন মানুষের কাছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি খরচ, প্রতিটি রক্ষণাবেক্ষণ নিজেই সামলাচ্ছেন তিনি। অর্থের সংকট আর ঋণের বোঝা নিয়ে হলেও তার বিশ্বাস, এই আর্কাইভ নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষার মহাসাগর। ভবিষ্যতে তিনি সরকারের হাতে এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঐতিহ্যের স্থায়ী সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে চান।
আরও পড়ুনঃ ইবি বঙ্গবন্ধু হল ডিবেটিং সোসাইটি’র নেতৃত্বে ফুয়াদ- তালুকদার
এখানে এসে দর্শনার্থীরা শুধু জিনিস দেখছেন না, বরং অনুভব করছেন বাংলাদেশের জীবন ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত ছবি। পুরনো দিনের জীবনযাত্রার ছবি যেন তাদের হৃদয়ে ঢেউ তোলে অতীতের প্রতি এক নতুন শ্রদ্ধার। আহসান কবির লিটনের এই নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা শুধু রাজশাহী নয়, বরং গোটা দেশের জন্য এক আলোকবর্তিকা।
আহসান কবির লিটন বলেন, এই আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করতে আমি ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করেছি এবং কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে একে দাঁড় করিয়েছি। সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং কর্মচারীদের বেতন আমি নিজেই বহন করি। সংগ্রহের পথে আমার অর্থনৈতিক ঋণের বোঝা বেড়েছে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এই প্রতিষ্ঠান নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষামূলক ও ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে আমি আশা করি, এই ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সাথে পরিচিত করাতে এবং প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে এর দায়িত্ব সরকারকে হস্তান্তর করতে পারব। নাটক ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই এই আর্কাইভের জন্ম।
আহসান কবির লিটন ১৯৯৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএস সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে নাটক প্রশিক্ষণ পদে যোগ দেন। নাটক ও সংস্কৃতি নিয়ে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহ্যের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা থেকেই তিনি ২০২৩ সালে এই ফিল্ম অ্যান্ড কালচারাল আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে পুরনো দিনের ব্যবহারিক জিনিসপত্র, ক্যামেরা, বই, বায়োস্কোপ, মুদ্রা আর ঐতিহাসিক নিদর্শন—সবকিছুই সংরক্ষিত আছে।