মোঃ আসিফুজ্জামান আসিফ, সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টারঃ প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েই অর্থমন্ত্রী থেমে থাকেননি। আদায়ে কঠোরতা এনেছেন। আবার অনেক খাতে রাজস্ব আরোপ করে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতার বইয়ে না রেখে অর্থবিলে স্পষ্ট করেছেন।আবাসনে কালো টাকা সাদার সু্যোগ ও শতাধিক পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। এর মধ্যে কমপক্ষে ২০টির মতো সমজাতীয় দেশি পণ্য স্থানীয় বাজারে সুবিধা পাবে।
আবাসন খাতে অবৈধ অর্থ সাদা করার সুযোগ দিয়ে এলাকাভেদে কর বেঁধে দিয়েছেন তিনি। অর্থবিল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বকেয়া ও নিয়মিত রাজস্ব আদায়ে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট-রাজস্ব আদায় এই তিন খাতের কর্মকর্তাদেরই ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে বকেয়া আদায়ে একবার নোটিশ দিয়েও হিসাব জব্দ করতে পারবেন যেকোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আনার প্রমাণ থাকলে এবং দুবারের বেশি অর্থ পাচারের প্রমাণ পেলেই ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক লাইসেন্স বাতিল করা যাবে।
বন্দর বা জাহাজ থেকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জরিমানা করতে পারবেন কয়েক শ গুণ।শুধু তা-ই না, ৫০টির মতো সরকারি সেবা নিতে হলে বাধ্যতামূলক ইটিআইএন থাকলেই হবে না, রিটার্ন দাখিলের কপি থাকতেই হবে। ঘোরাঘুরি বা বেড়াতে গিয়ে হোটেল বা রিসোর্টে থাকতে হলেও এখন থেকে রিটার্নের কপি দেখাতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য অপ্রদর্শিত অর্থ (কালোটাকা) ১৫ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ার, সিকিউরিটিজ, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, আর্থিক স্কিম ও ইন্সট্রুমেন্ট খাতে টাকা সাদা করা যাবে। তবে আবাসন খাতের জন্য নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
অর্থবিলে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ঢাকা জেলার গুলশান থানা, বনানী থানা, মতিঝিল থানা, তেজগাঁও থানা, ওয়ারী থানা, শাহবাগ থানা, রমনা থানা, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, পল্টন থানা, কাফরুল থানা, নিউ মার্কেট থানা ও কলাবাগানের অন্তর্গত সব মৌজার জন্য স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৬ হাজার টাকা এবং প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য কর ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে।
আরও পড়ুনঃ বৈধ আয়ের কর ৩০%, অবৈধ আয়ের কর ১৫%
ঢাকা জেলার মোহাম্মদপুর, বংশাল, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা মডেল, ক্যান্টনমেন্ট, চকবাজার, কোতোয়ালি, লালবাগ, খিলগাঁও, শ্যামপুর, শাহজাহানপুর, মিরপুর মডেল, দারুস সালাম, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ, শাহআলী, সবুজবাগ, কদমতলী, হাজারীবাগ থানাসহ অন্যান্য এলাকায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য ১০ হাজার টাকা কর দিতে হবে।
ঢাকা জেলার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, চট্টগ্রাম জেলার ইপিজেড, আকবর শাহ, কর্ণফুলী থানা, চকবাজার থানা অন্যান্য, গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর, বাসন, কোনাবাড়ী থানা অন্যান্য, টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানা ও আড়াইহাজার জেলার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গমিটারের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য ৩ হাজার টাকা কর দিতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও অন্য কোনো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভার অন্তর্গত সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গমিটারের জন্য ১ হাজার টাকা এবং প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।
এর বাইরে যেকোনো পৌরসভার সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৮৫০ টাকা এবং প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য ১ হাজার টাকা কর দিতে হবে। এসব এলাকার বাইরে সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৫০০ টাকা এবং প্রতি বর্গমিটার ভূমির জন্য ৩০০ টাকা কর দিতে হবে।
অর্থবিলে লাইসেন্সধারী আবাসন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ লাইসেন্স না নিয়েও যদি আবাসন ব্যবসা করতে থাকেন, তাদের জন্য কর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে আবাসিক উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের জন্য ১ হাজার ৬০০ টাকা, এসব আবাসিক উদ্দেশ্যে না হলে ৬ হাজার ৫০০ টাকা এবং ভূমির ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের ৫ শতাংশ কর দিতে হবে।
অর্থবিলে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে আমদানীকৃত হিমায়িত মাংস, বড় সামুদ্রিক মাছ, আড়াই কেজি পর্যন্ত বড় যেকোনো মাছ, চিজ ও দই, তাজা ও ঠাণ্ডা টমেটো, সবজি, নারকেল, সুপারি, লেবু, আম, আঙুর, আপেল, নাশপাতি, কফি, গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি, গোলমরিচ, এলাচ, দারুচিনি, জিরা, চকলেট, শিশুখাদ্য, মিষ্টি বিস্কুট, পটেটো চিপস, জ্যাম জেলি, ফলের রস, সস, আইসক্রিম, নন-অ্যালকোহলিক বিয়ার, মল্ট থেকে প্রস্তুত বিয়ার, অন্যান্য মদ, তামাকের তৈরি সিগারেট, চুরুট, হাতে তৈরি বিড়ি, সুগন্ধি, প্রায় সব ধরনের প্রসাধনী, শেভিং সামগ্রী, সাবানের দাম বাড়ানো হয়েছে।
একইভাবে আমদানীকৃত দেশলাই, আতশবাজি, প্লাস্টিক স্কুল ও অফিস সামগ্রী, প্লাস্টিকের তৈরি ঘর-গৃহস্থালির পণ্য, বোতল, ফ্লাস্ক, আমদানীকৃত সিগারেট, আমদানীকৃত সব ধরনের পোশাক, পশমি কম্বল, আসবাবপত্র, ফিল্টার, দুই ও চার স্ট্রোক সিএনজি, রঙিন টেলিভিশন, সুইচ-সকেট, হোল্ডার, মোটরগাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন, হাইব্রিড মোটরগাড়ি, স্টেশন ওয়াগন, মোটরসাইকেল, ইটের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাড়ানো হয়েছে আমদানীকৃত রিভলবার ও পিস্তল, বোমা, গ্রেনেড, মিসাইল ও সমজাতীয় গোলাবারুদ, তরবারি, ছোরার দামসহ অন্যান্য। এসব খাতের ন্যূনতম ২০টির বেশি খাত স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে সুবিধা পাবে। এ ছাড়া সম্পূরক শুল্ক আরোপের পরোক্ষ প্রভাবে দেশে তৈরি গাড়ি, মোটরসাইকেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়বে।
অর্থবিলে স্পষ্ট করলেন যে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ালেন না, সারচার্জে চেপে ধরলেন না। তবে গাড়ির পরিবেশ সারচার্জ, ধনীদের জন্য সারচার্জ, ন্যূনতম করহারও একই রাখার বিষয়টি অর্থবিলে জানিয়ে দিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কাজে নেওয়ার জন্য করছাড়ের কথা অর্থবিলে জানানো হয়েছে।