তানিম তানভীর, ইবি প্রতিনিধিঃ অভাব-অনটনকে জয় করে অনেকে এগিয়ে যান স্বপ্ন পূরণের পথে। তেমনই এক অনুপ্রেরণার গল্প আয়েশার। দারিদ্রতার কারণে যেখানে কলেজে ভর্তির আগেই থমকে যাচ্ছিল তার শিক্ষাজীবন, সেখানে পরিবারের সাহস, সংগ্রাম ও আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি জয় করেছেন বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষা।
টানা তিনবার ব্যর্থ হয়ে চতুর্থবারের চেষ্টায় আয়েশা সহকারী জজ হিসেবে ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় ৯৭তম স্থান অর্জন করেছেন। তার এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে রয়েছে পরিবার, বিশেষ করে তার মা ও স্বামীর অবদান।
১৯৯৭ সালের ১২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার অন্তর্গত বয়ড়াবাড়ী গ্রামে জন্ম আয়েশার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার বাবা ছিলেন একজন পরিশ্রমী মানুষ, কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিল না।
২০১৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও কলেজে ভর্তি হওয়া ছিল অনিশ্চিত। তখন তার মা রক্ত বিক্রি করেও মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের গহনা বিক্রি করে রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন আয়েশা। ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তির সাহায্যে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন এবং জিপিএ-৫ অর্জন করেন।
২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আইন বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও টিকে থাকার লড়াই নতুন করে শুরু হয়। সেন্ট্রাল ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেএম) বৃত্তির সহায়তায় তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং সিজিপিএ ৩.৪৪ অর্জন করেন।
আইন বিষয়ে পড়তে পড়তে তার বিচারক হওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। আইন বিভাগের বড় ভাই-বোনদের দেখে তার মনে জজ হওয়ার ইচ্ছা জাগে। তবে এই পথ মোটেও সহজ ছিল না। ২০২০ সালে অনার্সের শেষ বর্ষে থাকতেই আয়েশার বিয়ে হয়। তার স্বামী হাফেজ তাওহিদুল ইসলাম আইনের ছাত্র ছিলেন, যিনি তাকে সবসময় সাহস জুগিয়েছেন এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন।
বিয়ের পর তিনি পরিকল্পিতভাবে জুডিসিয়ারির প্রস্তুতি নেন। প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। আইনের কঠিন বিষয়গুলো তার স্বামী সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন, একসঙ্গে নোট তৈরি করতেন। তিনি লেখার গতি ও মানোন্নয়নের জন্য আলাদা সময় দিতেন।
আয়েশা মোট চারবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৪তম বিজেএস: প্রিলিমিনারিতে বাদ পড়েন। ১৬তম বিজেএস: ভাইভা পর্যন্ত যান, কিন্তু সফল হননি। ১৭তম বিজেএস: চতুর্থবারের চেষ্টায় সফল হন, সহকারী জজ হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
তার মা সবসময় বলতেন, "প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করেও তোমাকে পড়াবো, তুমি হাল ছেড়ো না।" বাবার পরিশ্রম, মায়ের ত্যাগ, স্বামীর উৎসাহ—সব মিলিয়ে তার এই সাফল্যের গল্প তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নিপীড়ন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে ফুলবাড়ীতে ছাত্রদলের মানববন্ধন
তার শ্বশুর-শাশুড়িও সাধ্যের মধ্যে সব ধরনের সহায়তা করেছেন। জীবনের কঠিন সময়ে স্বামী তাকে কুরআনের আয়াত পড়ে শুনিয়ে আশার আলো দেখাতেন।
বিচারক হিসেবে তিনি সততা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চান। যারা বিচারক হতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, "শুধু পড়াশোনা করলেই হবে না, হতে হবে কৌশলী। ধৈর্য, সততা, বিনয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, লিখিত পরীক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়মিত পড়াশোনা ও বারবার অনুশীলন করলেই সাফল্য পাওয়া সম্ভব।
আয়েশার এই সংগ্রামের গল্প অনেক তরুণ-তরুণীর জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, যারা দারিদ্র্য বা প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যেতে চায়। তিনি প্রমাণ করেছেন, পরিশ্রম, ধৈর্য ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।