তানিম তানভীর, ইবি প্রতিনিধিঃ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থী সাজিদ আব্দুল্লাহকে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। রবিবার (৩ আগস্ট) সাজিদ আব্দুল্লাহর মৃত্যুর ভিসেরা রিপোর্টে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ঘটনায় সাজিদ আব্দুল্লাহর হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, গত ১৭ জুলাই বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর থেকে তার ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সাজিদ ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল, সংস্কৃতিপ্রেমী ও বন্ধুবৎসল স্বভাবের। তার হঠাৎ চলে যাওয়া যেন মানতে পারছেন না কাছের বন্ধুরা।
ভিসেরা রিপোর্ট মতে, সাজিদের শরীরে কোনো বিষাক্ত পদার্থেও উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। রিপোর্টে শ্বাসরোধের (asphyxia) ফলে সাজিদের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পোস্টমর্টেমের সময় থেকে আনুমানিক ৩০ ঘণ্টা আগে তার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উচ্চতর তদন্তের সুপারিশ করেছে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। এতে সাজিদ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রশাসন।
এদিকে মৃত্যুর আগের দিন ১৬ জুলাই বিকেলে সর্বশেষ তাকে ক্যাম্পাসের জিয়া মোড়ে দেখা গিয়েছিল। এরপর থেকে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি সাজিদের। তার বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসময়ে বন্ধু সার্কেলের কারো সাথেই সাজিদের যোগাযোগ হয়নি। অনেক সহপাঠী কয়েকদফায় তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। তার তিন সহপাঠীর দাবি তারা সাজিদকে ফোন দিলে ফোন রিসিভ হয় কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি। ফলে মাঝখানের এই সময়টাতে সাজিদ কোথায় ছিলো, তার ফোন কিভাবে রিসিভ হলো এবং কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা যেন থামছে না।
জানা গেছে, সাজিদদের পাঁচজনের একটি ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ডসার্কেল ছিল। সার্কেলটির অন্য চারজন হলেন ইনসানুল ইমাম, উসামা বিন হাশেম, আজহারুল ইসলাম ও ইমরান জাহান। সকলেই ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ইনসান আল হাদীস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এবং অন্যরা সাজিদের বিভাগের। চারজনের মধ্যে ইনসান ও আজহারের সাথে সাজিদের পরিচয় হয় ঢাকায় তামীরুল মিল্লাতে পড়াকালীন সময় থেকেই। ক্যাম্পাসে আসার পর তাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হয়। দুইজনের মধ্যে আবার সাজিদের সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ছিল ইনসানের সাথে। এদিকে অন্য দুই বন্ধুর সাথে ক্যাম্পাসে আসার পরেই পরিচয়। ক্যাম্পাসে প্রায় সময়ই তারা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া করতেন। ক্যাম্পাসের জিয়া মোড়ে সাজিদ, ইনসান ও আজহার একসঙ্গে ছোট পরিসরে একটি ব্যবসাও পরিচালনা করতেন।
আরও পড়ুনঃ সাজিদ হত্যায় উচ্চতর তদন্তের সুপারিশ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির
সাজিদের বন্ধু ইনসানুল ইমাম বলেন, সাজিদের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব ছিলো, এটা সবাই জানতো। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবে না। ক্লাস-পরীক্ষা আর ঘুম ছাড়া প্রায় সময়েই আমরা একসাথে থাকতাম। ক্যাম্পাসে আমি সাজিদকে এভাবে কখনও একা থাকতে দেখিনি। বেশিরভাগ সময় তো আমরাই একসাথে থাকতাম আর আমরা না থাকলেও সাথে জেলার বন্ধু অথবা অন্য কোনো জুনিয়র থাকতো।
ইনসান বলেন, আমার সাথে সাজিদের সর্বশেষ দেখা হয় ১৬ জুলাই দুপুর ২টার আগে। ওইদিন দুপুর ২টার দিকে আমার জেলার বড় ভাই উত্তম দাদার সৎকারের উদ্দেশ্য আমি দিনাজপুর গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পরের দিন (১৭ জুলাই) সকাল ৯টায় ক্যাম্পাসে আসি। তখন আমি সোজা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে বিকাল ৫টার পরে। তখন আমি সাজিদকে ফোন দেই কিন্তু তা রিসিভ হয়নি। এর মাঝে ফেসবুকে ঢুকে দেখি পুকুরে একটি লাশ ভেসে উঠেছে। কিন্তু তখনও লাশের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। চারুকলা বিভাগের বান্ধবী ঐশীও আমাকে কল দিয়ে পুকুরে লাশ ভেসে ওঠার বিষয়টি জানায়। পরে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে সাজিদের নাম্বারে আবার কল দিলে ২৫ সেকেন্ডের জন্য রিসিভ হয়। কিন্তু অপরপাশ থেকে কারও কথা শোনা যায়নি। পরে ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বানী ভাই আমাকে ফোন দিয়ে সাজিদের খোঁজ নিতে বলেন। তখন আমি সাজিদের রুমের সামনে যাই। দরজা বন্ধ ছিল দেখে ধাক্কা দিই। সাজিদের রুমে সামনে থেকে ছিটকিনি আছে কিন্তু আমি সামনে থেকে রুমের ভিতরের দিকে ধাক্কা দিলে খোলেনি! ওই সময় আমার সেন্স ছিলনা যে, বাইরে টান দিলে দরজা খোলে। পরে সাজিদের রুমের দরজা না খুলতে পেরে সেখান থেকে আমি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পুকুরঘাটের দিকে যাই। গিয়ে দেখি সাজিদের মৃতদেহ! এরপর আমি একেবারেই ভেঙ্গে পড়ি। লাশ উদ্ধারের পর সাজিদের পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য আমার এক জুনিয়রের মাধ্যমে তার কক্ষ থেকে ফোনটি নিয়ে আসি। সে আনসার সদস্যকে নিয়ে ফোনটি নিয়ে আসে।
সাজিদের সঙ্গে কারোর ব্যক্তিগত মনোমালিন্য ছিল কি না জানতে চাইলে ইনসান বলেন, সাজিদ মুটামুটি সব বিষয়গুলো আমাকে জানাতো। আমার জানামতে কারোর সঙ্গে তার মনোমালিন্য বা এমন কিছু ছিলো না।
সাজিদের বন্ধু ইমরান জাহান বলেন, লাশ উদ্ধারের আগের রাত ৮ টা ৪৮ মিনিটে আমি সাজিদকে কল দিলে ১৪ সেকেন্ডের মতো কল রিসিভ হলেও অপরপাশ থেকে কোন কথা শোনা যায়নি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যার কারনে কথা শোনা যায়নি। এজন্য আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।
আরেক বন্ধু উসামা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন একই মেসে ছিলাম। একসঙ্গে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি ও আড্ডা দিয়েছি। সাজিদের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) রাতে। সেদিন আমি বাসায় চলে যাই। পরদিন ১৬ তারিখ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আমার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার বিষয়ে সাজিদের সাথে মেসেজে কথা হয়েছিল। এরপর আর সাজিদের সাথে আমার কথা হয়নি। পরে ১৭ তারিখ জানতে পারি পুকুরে সাজিদের লাশ পাওয়া গেছে।
সাজিদের বন্ধু আজহার ইসলাম বলেন, সাজিদের সাথে সর্বশেষ দেখা হয় ১৫ জুলাই দুপুরে। বিভাগ থেকে ফর্ম ফিলাপের কাজ শেষ করে আমরা একসাথে জিয়া মোড়ে খাওয়া দাওয়া করি। পরদিন ১৬ জুলাই দুপুর ৩ টা ২০ মিনিটের দিকে সাজিদকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেই, “ভিজবেন নাকি?” ম্যাসেজ ডেলিভারি হলেও সাজিদ সেটি সিন করেনি। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শহীদ জিয়া হলে সাজিদের রুমে গিয়ে দেখি রুমে তালা লাগানো। তাকে রুমে না পেয়ে আমি শহীদ মিনারে ছাত্রদলের প্রোগ্রামে চলে যাই। পরদিন ১৭ জুলাই সকাল সোয়া ৭ টার দিকে আমরা হল থেকে বের হয়ে জিয়া মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে সাজিদকে ডাক দিলেও কোন সাড়া পাইনি। পরে জিয়া মোড় থেকে চা খেয়ে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা ৬টা ৪৮ মিনিটের দিকে ইমরান আমাকে ফোন দিয়ে সাজিদের লাশ পাওয়ার বিষয়টি জানায়। খবরটি শুনেই আমি থমকে যাই। যে ছেলেটা ভালো সাঁতার জানতো সে পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে এমনটা মনে হয় না।
আজহার জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটি মেসে ইনসান, সাজিদ ও আমি একই রুমে থাকতাম। ইনসান, সাজিদ, উসামা, ইমরান, মুহিব, রিয়াদ, যায়েদ ও আরিফসহ আমরা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি ও আড্ডা দিতাম। আমরা ছাড়াও রাদিফা, আমেনা, জেমি, খাদিজা, আখিসহ জেলার বেশকিছু বন্ধুবান্ধবীর সাথে সাজিদের চলাফেরা ছিলো। তারা একসঙ্গে আড্ডা দিত। তাদের সেভাবে চিনি না। এ ছাড়া সাজিদের ব্যক্তিগত কোন বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে কথা হতো না বা এসব শেয়ার করতো না।
আজহার আরও বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে আমরা সাক্ষাৎকার দিয়েছি। যা জানি বিস্তারিত বলেছি। যতটুকু শুনেছি তার জেলার কোন বন্ধুবান্ধবীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি। সাজিদ যেহেতু জেলার অন্যদের সাথেও ভালো চলাফেরা করতো। সাজিদ তাদের সাথে কোন পার্সোনাল কোন কিছু বিষয় শেয়ার করছে কি না সেগুলোও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করি।