
সায়মা আনান প্রমি, খুবি প্রতিনিধিঃ প্রতিদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর, সন্ধ্যার আলো ছুঁতে না ছুঁতেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজিতা হলের সামনে ভিড় জমে এক চেনা ভ্যানের পাশে। সেখানে নেই কোনো আধুনিক খাবার দোকান, নেই দামি ফুড কার্ট—আছে শুধু এক টুকরো হাসি, এক মুঠো ঝালমুড়ি আর এক বুক গল্পের মানুষ। তিনি গাজী মামা। বয়স প্রায় ৭৫। বয়সের ভারে শরীর খানিকটা নুয়ে এলেও মুখে থাকেনা ক্লান্তির ছায়া।
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিনি। কেউ বলেন “গাজী মামার ঝালটা একটু বেশি!”, কেউ বলেন “মামা একটু মিষ্টি দেন!”—সবার পছন্দমতো ঝালমুড়ির স্বাদ তৈরি করে দেন এই প্রিয় মানুষটি। তার হাতের মাখানো মুড়ির স্বাদ যেমন অনন্য, তেমনি শিক্ষার্থীদের প্রতি তার ভালোবাসাও বিশুদ্ধ।
একদিন এক শিক্ষার্থীর কৌতূহলে তার জীবনের গল্প বেরিয়ে আসে। খুলনার এক অখ্যাত গ্রামে মামার জন্ম। কৃষক বাবার অভাবী সংসারে শৈশবেই থেমে যায় লেখাপড়া। কিশোর বয়সেই শুরু হয় জীবিকার যুদ্ধ—রিকশা চালানো, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান চালানো শেষে শেষ ভরসা হয় এই ভ্যানের ঝালমুড়ি বিক্রি।
দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অপরাজিতা হলের সামনে নিয়মিত উপস্থিত হন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি কেবল মুড়িওয়ালা নন—তিনি হলেন পরিবারের একজন মতো। কারও ক্লাসের ক্লান্তি, কারও মন খারাপের দিনে তার ঝালমুড়ি আর হাসিমাখা মুখটাই হয়ে ওঠে সান্ত্বনার উৎস।
মামার দিন শুরু হয় সকাল থেকেই। বাজার থেকে মুড়ি, চানাচুর, লেবু, পেঁয়াজ-মরিচ, ছোলা, আলু আর প্রয়োজনীয় মসলা কিনে বেলা ১১টার দিকে হাজির হন অপরাজিতা হলের সামনে। বিকেল থেকেই জমে ওঠে তার ভ্যান। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলতে থাকে বিক্রি। এরপর ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরেন, যেখানে অপেক্ষা করে তার স্ত্রী ও দুই নাতনি।
আরও পড়ুনঃ শেরপুরে গৃহে ডাকাতি: গুরুতর আহত ইসলামী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহীন আলম
তার সংসার চলে শুধুই এই ঝালমুড়ির ভ্যান ঘিরে। বয়স বাড়লেও থেমে নেই তার সংগ্রাম। তার শরীর যতই কুঁজো হোক, তার আত্মা এখনও দৃঢ়, তার মুখে হাসি আজও অটুট।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে গাজী মামা শুধু একজন মুড়িওয়ালা নন—তিনি এক অনন্য প্রাণ, এক জীবনযোদ্ধা, যিনি জীবনযুদ্ধে হার মানেননি, যিনি প্রতিদিনই আমাদের শেখান, সত্যিকারের নায়ক হতে কোনো কেতাব লাগে না। তাঁর মতো মানুষই সমাজে নিঃশব্দে বুনে যান ভালোবাসার ছায়া।
তিনি যেন অপরাজিতা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত প্রেরণা—খুলনার ক্যাম্পাসজুড়ে যাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে, মন থেকে মনে।