মোঃএমরুল ইসলাম, নরসিংদী জেলা প্রতিনিধিঃ ইসলামি দিবস হিসেবে ‘আখেরি চাহার সোম্বা’ নামে এক দিবস সমাজে পালিত হয়ে আসছে। অথচ শরিয়তের মানদণ্ডে এ দিবসের কোন ভিত্তি নেই। এ দিবসকে কেন্দ্র করে কোনো আমলেরও ভিত্তি নেই।
আখেরি চাহার সোম্বা অর্থ শেষ বুধবার। আখেরী চাহার সোম্বা বলতে সফর মাসের শেষ বুধবারকে বোঝানো হয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ১১ হিজরীর সফর মাসের শেষ দিকে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এ বিষয়ে প্রচলিত রয়েছে যে, এক ইহুদি কবিরাজ রাসূল (সাঃ)-এর চুল মোবারক নিয়ে জাদুটোনা করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সফর মাসের শেষ বুধবার তিনি কিছুটা সুস্থতাবোধ করে গোসল করেন এবং দুজন সাহাবির কাঁধে ভর করে মসজিদ-ই-নববীতে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। ফলে মুসলমানরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান। সবাই সাধ্যমতো দান-সদকা করেন। শুকরিয়ার নামাজ ও দোয়া করেন অনেকে। কেউ কেউ দাস মুক্ত করে দেন। অবশ্য বিকেলেই তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর সুস্থতায় আর উন্নতি হয়নি, তিনি আর গোসলও করেননি। পরে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ইন্তেকাল করেন।
মূলত এই ঘটনার কোনও ভিত্তি নেই। কিন্তু অনেকেই উল্লিখিত ঘটনার আলোকে সফর মাসের শেষ বুধবার কে আখেরী চাহার সোম্বা‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। সরকারিভাবে ঐচ্ছিক ছুটি পালন করা হয়। কিন্তু কোরআন, হাদিসের আলোকে আখেরী চাহার সোম্বা ও এই দিনকে কেন্দ্র করে আমল একেবারেই ভিত্তিহীন। এ প্রসঙ্গে নিচে আলোচনা করা হলো।
১) রাসুল (সাঃ)-এর ওপর এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা ছিল হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে সপ্তম হিজরির মহররম মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। এই জাদুর প্রভাব কত দিন ছিল, সে সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের কথা এসেছে, অন্য বর্ণনায় এসেছে ৪০ দিনের কথা। তবে যাই হোক, সুস্থতার তারিখ কোনোভাবেই ১১ হিজরীর সফর মাসের ‘আখেরী চাহার সোম্বা’ বা ‘শেষ বুধবার’ হতে পারে না। (ফাতহুল বারি: ১০/২৩৭, আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া: ২/১৫৪, শরহুজ জুরকানি: ৯/৪৪৬-৪৪৭)
২) রাসুল (সাঃ) এর সুস্থতার জন্য যে সাত কুয়া থেকে সাত মশক পানি আনা হয়েছিল এবং সুস্থতার জন্য তাঁর দেহ মোবারককে ধৌত করা হয়েছিল, তা কি বুধবারের ঘটনা না বৃহস্পতিবারের? ইবনে হাজার ও ইবনে কাসির একে বৃহস্পতিবারের ঘটনা বলেছেন। (ফাতহুল বারি: ৭/৭৪৮, কিতাবুল মাগাজি: ৪৪৪২, বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪/১৯৩, সিরাতুন নবী, শিবলী নোমানী: ২/১১৩)
৩) বুধবারের পর রাসুল (সাঃ) আর গোসল করেননি—এ তথ্যও সঠিক নয়। কেননা এরপর এক রাতে ইশার নামাজের আগে গোসল করার কথা সহিহ হাদিসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। (মুসলিম: ৪১৮, বুখারি: ৬৮১)। আর এ কথাও ঠিক নয় যে, বুধবারের পর সুস্থতায় কোনোরূপ উন্নতি হয়নি। বরং এরপর আরেক দিন সুস্থতাবোধ করেছিলেন এবং জোহরের নামাজে শরিক হয়েছিলেন। (বুখারি: ৬৬৪, ৬৮০, ৬৮১, মুসলিম: ৪১৮)
এমনকি সোমবার সকালেও সুস্থতাবোধ করেছিলেন। যার কারণে হজরত আবু বকর (রা.) অনুমতি নিয়ে নিজ ঘরে চলে গিয়েছিলেন। (সিরাতে ইবনে ইসহাক, পৃ-৭১১-৭১২, আর রাওজাতুল উলুফ: ৭/৫৪৭-৫৪৮)
৪) রাসুল (সাঃ)-এর সুস্থতার কারণে খুশি হওয়া কিংবা তাঁর সুস্থতার সংবাদ পড়ে আনন্দিত হওয়া প্রত্যেক মুমিনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ কথা দাবি করা প্রমাণহীন যে, সাহাবায়ে কেরাম কিংবা পরবর্তী যুগের মনীষীরা সে খুশি প্রকাশের জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন কিংবা একে উদযাপনের দিবস ঘোষণা করেছেন। এ দাবির সপক্ষে দুর্বলতম কোনও দলিলও বিদ্যমান নেই।
আরও পড়ুনঃ ইসলামীক রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিৎ?
৫) রাসুল (সাঃ)-এর ওপর অনেক মসিবত এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নাজাত দিয়েছেন। তায়েফ ও ওহুদে আহত হয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। একবার ঘোড়া থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছেন, যার কারণে মসজিদে যেতে পারেননি। আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করেছেন। তাঁর সুস্থতা লাভের এসব আনন্দের স্মৃতিগুলোতে দিবস উদযাপনের কোনও নিয়ম আছে? তাহলে আখেরী চাহার সোম্বা, যার কোনও ভিত্তি নেই, তা কীভাবে উদযাপনের বিষয় হতে পারে!
৬) কোনও দিনকে বিশেষ ফজিলতের দিবস মনে করা কিংবা বিশেষ কোনও আমল রয়েছে বলে বিশ্বাস করা কিংবা তাকে ধর্মীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা শরিয়তের বিধানের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, এগুলো ইসলামি শরিয়তের দলিল ছাড়া শুধু মনগড়া যুক্তির ভিত্তিতে তা সাব্যস্ত করা যায় না। এটি শরিয়তের একটি অবিসংবাদিত মূলনীতি। সুতরাং উপরোক্ত তথ্য ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ হলেও এ দিবসকে ঘিরে ওই সব রসম-রেওয়াজ জারি করার কোনও বৈধতা সাব্যস্ত হয় না।
আল্লাহ তা,আলা মুসলিম উম্মাহকে সঠিক উপলব্ধি দান করুন এবং সব ধরনের রসম-রেওয়াজ থেকে রক্ষা করুন। আমিন।