
প্রযুক্তি, সামাজিক মাধ্যম ও বৈশ্বিক নীতিতে Meta Platforms-এর এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। কোম্পানি একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ গঠনে কাজ করছে, অন্যদিকে শিশু-কিশোর নিরাপত্তা, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির সম্প্রসারণ, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নীতি ও আইনগত চাপের মাঝে নিজেদের অবস্থান নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। সাম্প্রতিক ঘোষণাগুলো শুধু Meta নয়, গোটা প্রযুক্তি শিল্পকেই নতুন দিকনির্দেশ দিচ্ছে।
প্রযুক্তির নতুন গন্তব্য: AI-র সুপারইন্টেলিজেন্স ল্যাব
Meta Platforms তাদের সর্বশেষ উদ্যোগ হিসেবে চালু করেছে Superintelligence Lab, যেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ChatGPT ও GPT-4-এর সহ-নির্মাতা Shengjia Zhao-কে প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে। এই ল্যাবের লক্ষ্য কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (AGI) তৈরির মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমকক্ষ প্রযুক্তি তৈরি করা। Meta জানিয়েছে, ল্যাবটি তাদের বিদ্যমান FAIR গবেষণা বিভাগের বাইরে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হবে এবং Llama ভাষা মডেল, Meta AI চ্যাটবট ও স্মার্ট গ্লাসের মতো উদ্ভাবনী প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করবে।
Meta-র প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ঘোষণা করেছেন, ২০২৫ সালে শুধুমাত্র AI-ভিত্তিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাপন শিল্পে কয়েকশো বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে। এর ফলে বিজ্ঞাপন নির্মাণে স্বয়ংক্রিয় কন্টেন্ট তৈরি, উন্নত টার্গেটিং এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য AI নির্ভর সরঞ্জাম উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ Meta-কে গুগল ও ওপেনএআই-এর সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনবে।
তরুণদের সুরক্ষা: Meta-র অগ্রাধিকার
সামাজিক মাধ্যমের নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়া Meta এবার তরুণ ব্যবহারকারীদের সুরক্ষায় নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। Instagram, Facebook ও Messenger-এ চালু হয়েছে টিন অ্যাকাউন্ট প্রোটেকশন সিস্টেম। নতুন ফিচারগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিচিত ব্যক্তির বার্তায় সতর্কবার্তা, প্রোফাইলে অ্যাকাউন্ট তৈরির তারিখ প্রদর্শন, এবং এক-ক্লিকে ব্লক ও রিপোর্টের সুবিধা।
এর পাশাপাশি, কোম্পানি ৬ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করেছে, যেগুলোর মধ্যে ১ লাখ ৩৫ হাজার অ্যাকাউন্ট শিশুদের শ্লীলতাহানি বা যৌন হয়রানির অভিযোগে বন্ধ করা হয়েছে। Meta জানিয়েছে, শিশু ও কিশোরদের সাইবার নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।
ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও Horizon OS: ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতায় বিপ্লব
Meta Quest ও মেটাভার্স ব্যবহারকারীদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে Horizon OS v78 এবং Horizon Worlds v78। নতুন সংস্করণে যুক্ত হয়েছে Dolby Atmos সাপোর্ট, Avatar Self-view ক্যামেরা, এবং অ্যাক্সেসিবিলিটি ফিচারের উন্নয়ন। Horizon Worlds-এ যুক্ত হয়েছে বাগ ফিক্স, আলো ও ভিজ্যুয়াল মানোন্নয়ন এবং আরও সহজ ব্যবহারযোগ্য ইন্টারফেস।
Meta-র বক্তব্য অনুযায়ী, এই আপডেটগুলো মেটাভার্স অভিজ্ঞতাকে আরও জীবন্ত ও স্বচ্ছন্দ করবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ Meta-র VR ইকোসিস্টেমকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করবে এবং Apple Vision Pro ও অন্যান্য VR প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমকক্ষ লড়াইয়ে নামাবে।
আরও পড়ুনঃ ক্রিপ্টোকারেন্সি : ডিজিটাল অর্থের নতুন যুগ
ইউরোপে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন Transparency and Targeting of Political Advertising (TTPA) আইন মেনে চলতে গিয়ে Meta ঘোষণা করেছে, ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে তারা ইউরোপে কোনো পেইড রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়বস্তু বিজ্ঞাপন চালাবে না।
Meta জানিয়েছে, ব্যবহারকারীরা সাধারণ পোস্টের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতামত শেয়ার করতে পারবেন, তবে এসব পোস্টকে বুস্ট বা পেইড প্রমোশনের মাধ্যমে ছড়ানো যাবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত ইউরোপে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় প্রভাব ফেলতে পারে, যদিও এটি স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আইনগত ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ
Meta-কে বর্তমানে বেশ কিছু আইনগত ও আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ইতালিতে কোম্পানির বিরুদ্ধে ১ বিলিয়ন ইউরোর বেশি ভ্যাট (VAT) দাবির মামলা চলছে, যা নিয়ে Meta আদালতে আপিল করেছে। কোম্পানির দাবি, তারা আন্তর্জাতিক কর কাঠামো মেনে চলেছে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ বিলিয়ন ডলারের শেয়ারহোল্ডার মামলা থেকে সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস ও সিইও মার্ক জাকারবার্গ। মামলাটিতে অভিযোগ ছিল, Meta ব্যবসায়িক কৌশল ও আর্থিক তথ্য গোপন রেখে শেয়ারহোল্ডারদের বিভ্রান্ত করেছে। সমঝোতার মাধ্যমে এই অধ্যায়ের অবসান ঘটলেও কোম্পানির সুনাম ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর এর প্রভাব রয়ে গেছে।
Meta বর্তমানে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পেতে কাজ করছে। একদিকে তারা AI, মেটাভার্স ও বিজ্ঞাপন শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে চাইছে, অন্যদিকে শিশুদের সুরক্ষা, ইউরোপীয় নীতি ও আইনগত বাধ্যবাধকতা মানতে হচ্ছে।
প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, Meta-র সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো কোম্পানিকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করতে পারে, তবে এসব নীতিগত পরিবর্তন এবং আইনগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই তাদের ভবিষ্যতের সফলতার চাবিকাঠি হবে।