পাভেল ইসলাম মিমুল, স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পিএলসি-তে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের প্রভাবিত একাধিক সিন্ডিকেট। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশা তৈরি হলেও, ব্যাংকটিতে সেই পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিফলন হয়নি। বরং নতুন মুখোশে পুরনো চক্রবদ্ধ সিন্ডিকেট আবারও নিজেদের জাঁকিয়ে বসাতে শুরু করেছে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই বিতর্কিত নেতা—আওয়ামী ঘনিষ্ঠ মো. আব্দুল আউয়াল এবং বিএনপি ঘনিষ্ঠ সিবিএ নেতা মো. জাকির হোসেন।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সিবিএ সভাপতি জাকির হোসেন ঢাকা থেকে একটি দল নিয়ে রাজশাহীতে এসে সিবিএ-২০২ এর সহ-সভাপতি আউয়ালকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালান। লক্ষ্য ছিল রাজশাহী জোনের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) খোকন চন্দ্র বিশ্বাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করে বদলির আদেশ কার্যকর করানো।
বিশেষ সূত্র বলছে, এই তৎপরতার পেছনে রয়েছে বিপুল অর্থ লেনদেন ও প্রভাব বিস্তার। বরাবরের মতো এবারও “রিকোয়েস্ট অর্ডার”-এর নামে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।
আগেও মামলা, জেল: তবুও বহাল সিন্ডিকেট
সিবিএ সভাপতি জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক চাঁদাবাজি মামলার নথি রয়েছে। স্টাফ বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বারবার এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সিন্ডিকেট শুধু চাঁদাবাজ নয়—এটি একটি অপরাধপ্রবণ রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া আউয়াল ও মুজাহারকে সেই সময় পাবনায় বদলি করা হয়। আজ আবার সেই বিতর্কিতদের ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন জাকির হোসেন।
সিন্ডিকেট সদস্যদের তালিকায় আছেন— বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ও এজিএম এ এইচ মাহমুদুন্নবী, উপদেষ্টা মো. কামরুজ্জামান, সহ-সভাপতি জয়ন্ত কুমার সরকার, স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আবিদ হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোছা. নুরজাহান শিউলি।
এরা প্রত্যেকে প্রিন্সিপাল অফিস ও জিএম অফিসে থেকে প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের অনুসারীদের বসানো, চাঁদা আদায় এবং বদলি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় রয়েছেন।
সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের একাংশও এই সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আজ চরম হয়রানির শিকার। বিশেষ করে যারা ৫ আগস্টের গণআন্দোলনে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, তাদের বদলি করে দূরবর্তী ও গুরুত্বহীন শাখায় পাঠানো হচ্ছে।
জিএম খোকন চন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, “বদলির কোনো চূড়ান্ত আদেশ দেওয়া হয়নি, তবে কিছু লোক চাপ প্রয়োগ করছে।” প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সিবিএ প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে তাকে চাপ প্রয়োগের ঘটনাও ঘটে।
সিবিএ সভাপতি জাকির হোসেন অবশ্য সাংবাদিকদের বলেন, “তাঁরা কর্মচারী সমাবেশ করতে এসেছেন,” তবে বদলির বিষয়ে তিনি গোপনীয়তা দেখানোর চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুনঃ কোটা প্রথা বহাল শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, ইবিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “যদি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোই চাঁদাবাজি, বদলি-বাণিজ্য আর রাজনৈতিক দালালদের দখলে চলে যায়, তবে তা শুধু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্যই নয়—জনগণের আস্থার জন্যও চরম হুমকি।”
তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
“সোনালী ব্যাংকের মতো রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি রাজনৈতিক ও অপরাধপ্রবণ চক্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের সম্পদ জিম্মি হয়ে পড়বে—এটি আরেক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা।” – এক সাবেক ব্যাংক পর্যবেক্ষক কর্মকর্তার মন্তব্য
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ গঠনের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা এই সিন্ডিকেটের পুনর্জাগরণে মারাত্মকভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এই চক্রবদ্ধ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কতটা দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা ছাড়া এই নেটওয়ার্ক ভাঙা প্রায় অসম্ভব।