মোঃ সাকিবুল ইসলাম স্বাধীন, রাজশাহী প্রতিনিধিঃ এই রাষ্ট্রে কি সত্য বলা অপরাধ? দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফেসবুক লাইভে প্রতিবাদ করলেই কি মৃত্যুদণ্ড লেখা থাকে? গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ততম চৌরাস্তার বুকে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা—বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে আরেকটি রক্তাক্ত কালিমা হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে গাজীপুর শহরের মসজিদ মার্কেটের সামনে এক চায়ের দোকানে বসা অবস্থায় নির্মম এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। নিহত সাংবাদিক তুহিন (৩৮) ছিলেন ‘দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ’-এর স্টাফ রিপোর্টার। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামে হলেও পেশাগত কারণে পরিবারসহ থাকতেন গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়।
ঘটনার কিছু ঘণ্টা আগেই তুহিন তার ফেসবুক লাইভে গাজীপুর চৌরাস্তার ফুটপাত ও দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সরব হন। লাইভে দুর্নীতির বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়, যেন এক নির্মম প্রতিশোধের চিহ্ন এঁকে গেলো তার নিথর দেহে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৩-৪ জন মুখোশধারী সন্ত্রাসী হঠাৎ এসে তুহিনের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপস্থিত লোকজনের সামনেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে তাকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সাহসী এই সংবাদকর্মী।
ঘটনার পরপরই বাসন থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠালেও হত্যার মোটিভ বা জড়িতদের বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, “তদন্ত চলছে।” তবে প্রত্যক্ষদর্শী, ফেসবুক লাইভ এবং হত্যাকাণ্ডের ধরন বিশ্লেষণ করে অনেকেই বলছেন, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত, টার্গেট কিলিং এবং প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় পরিচালিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
সাংবাদিক তুহিনের নির্মম মৃত্যুতে দেশজুড়ে সাংবাদিক সমাজে নেমে এসেছে তীব্র শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড়। তার সহকর্মীরা বলছেন, তিনি ছিলেন এক আপোষহীন কণ্ঠ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিক।
আরও পড়ুনঃ সাভারে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের মেধাবৃত্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম উদ্বোধন
‘দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ’-এর সম্পাদক মোঃ খায়রুল আলম রফিক বলেন, “তুহিন ছিলেন সত্য ও সাহসের প্রতীক। তার এই নির্মম মৃত্যু শুধু একজন সাংবাদিকের প্রাণনাশ নয়, বরং স্বাধীন সাংবাদিকতার গলায় ছুরি চালানোর শামিল।”
তুহিনের সহকর্মী ও বন্ধু সাংবাদিকরা জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই গাজীপুরের বিভিন্ন দুর্নীতিবাজ চক্র, চাঁদাবাজি ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করে আসছিলেন। তার ফেসবুক লাইভ ও রিপোর্ট ছিল স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্রের গাত্রদাহের কারণ।
শুক্রবার সকালে গাজীপুর প্রেসক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক সমাজ বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি হয়েছে তীব্র জনরোষ। সাংবাদিকরা এক বাক্যে বলছেন—তুহিন হত্যার পেছনের কুশীলবদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করা হলে তা সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে আরও হুমকির মুখে ফেলবে।
এই হত্যাকাণ্ড আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়, এদেশে সত্য বলার মূল্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তুহিনের রক্তের দাগ সাংবাদিক সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে—এবার তারা শুধু শোক নয়, জবাবদিহির দাবিতে সোচ্চার।