মোঃ সাকিবুল ইসলাম স্বাধীন, রাজশাহী প্রতিনিধিঃ গত ৫আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে রাজশাহীর সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ও তাঁর পরিবার দেশ ছেড়ে পালানোর কথা রাজশাহী বাসীর মুখে মুখে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে মেয়র ও তার পরিবারের টাকা যোগান ও ছাত্রদের উপড়ে হামলা করার নির্দেশের প্রধান এই পরিবারের ৩ সদস্য বৃন্দ, তারই কন্যার পলাতক থেকে সরকারি বেতন উত্তোলন করছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৫ তারিখের আগেই লিটনের দুই মেয়ে, স্ত্রী ও জামাতা দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে লিটনের মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) চিকিৎসা কেন্দ্রের সাধারণ চিকিৎসক আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান। পলাতক থেকেও নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন লিটন কন্যা অর্ণা।
আনিক ফারিয়া জামান অর্ণা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের বড় কন্যা। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়াও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এ নেত্রী। ২০১৯ সালে সাবেক উপাচার্য এম. আব্দুস সোবহান মেয়রকন্যা অর্ণাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে এডহকে নিয়োগ দেন। তবে সে নিয়োগ নিয়েও আছে প্রশ্ন। অভিযোগ আছে পর্যাপ্ত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কেবল মেয়রের মেয়ে হওয়ার কারণেই নিয়োগ পেয়ে যান অর্ণা।
অফিসে আসতেন নিজের খেয়াল-খুশিমত। ২০১৯ সালের ১ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের সময়ে বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে সেন্টারে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়ার পর নিজের খেয়াল-খুশিমত অফিস করতেন অর্ণা।
রাবি চিকিৎসা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ অফিস করেছিলেন আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা। এদিকে, গত ৯ মাসে আর অফিস করতে দেখা যায়নি তাকে। অফিস না করেও গত ৯ মাসে সরকারি বেতন-ভাতা পেয়েছেন প্রায় ৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। অষ্টম গ্রেডের বেতন-ভাতা পেতেন তিনি।
৬ মাস পরপর নবায়ন করে গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে রাবির মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত রয়েছেন অর্ণা। তার সর্বশেষ ছয় মাসের জন্য নবায়নকৃত চাকরির মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ সাল পর্যন্ত। যদি নতুন করে নবায়ন করা না হয় তাহলে এমনিতেই চাকরি হারাবেন একসময় রাজশাহী শহরে প্রভাব বিস্তার করা সাবেক মেয়রের মেয়ে অর্ণা।
চাকরিতে প্রবেশের সাড়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও তাকে রাবির চিকিৎসক হিসেবে চিনেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। মাসে দুই একদিন অফিস করেই পুরো মাসের বেতন হাতিয়ে নিতেন তিনি। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রভাবসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
মেডিকেলের অন্যান্য চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে নিয়মিত কখনোই অফিস করতে দেখা যায়নি অর্ণা জামানকে। মাসে দুএকদিন অফিস করতেন তিনি। সকাল ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তার ডিউটি থাকলেও মেয়র কন্যা অর্ণা অফিস করতেন ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত। অফিস চলাকালে তার সাথে থাকতেন একাধিক অস্ত্রধারী বডিগার্ড ফলে মেডিকেলের অন্যান্য চিকিৎসকরাও এ নিয়ে খুব আতঙ্কে থাকতেন। তার অফিস টাইমের পুরো সময় জুড়ে চেম্বারের সামনে ভিড় করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রুয়েট ও রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতেন; এতে রোগ নির্ণয়ের জন্য আসা সাধারণ শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা সেবা না নিয়েই ফিরে যেতেন।
আরও পড়ুনঃ ফিরোজ হাসানের বিরুদ্ধে শহীদের রক্তের সাথে তামাশার অভিযোগ
সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ চিকিৎসককে কখনোই মেডিকেল সেন্টারে দেখেননি। মেডিকেল সেন্টারে লিটন কন্যা আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা নামে চাকরি করেন এটাই অনেকে জানেন না। কিছু শিক্ষার্থী তার বিষয়ে জানলেও তার চেম্বারের সামনে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ও অর্ণার বডিগার্ডের ভয়ে চিকিৎসা নিতে যেতেন না।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণার ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল-মেসেজ দিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক ডা. মাফরুহা সিদ্দিকা লিপি বলেন, ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা বিগত ৮/৯ মাস ধরে ডিউটি করছেন না; তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বেতনভাতা ঠিকই পাচ্ছেন। আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাকে রিচ করতে পারিনি। এ বিষয়টি অভিযোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে অবগত করেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা ভালো মনে করেন তাই করবেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ হাসান নকীব বলেন, “৫ই আগস্টের পর যে সকল শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিজ দপ্তরে উপস্থিত নেই আমরা তাদের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছি। তবে আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা যেহেতু ৯ মাস ধরে অফিস করছেন না তার বিষয়টি অবশ্যই ভিন্নভাবে দেখতে হবে। তার বিষয়টি বিস্তারিত জেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”