
মোঃ আব্দুল আলিম, রাজশাহী প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর জাদুঘর মোড়। জনস্রোতের মাঝে অগোচরে রাস্তার পাশে বসে থাকেন এক মধ্যবয়সী মানুষ, চোখে চশমা, গায়ে ক্লান্তি—তবুও বিকেল হলেই তিনি হাজির হন নিজের ছোট্ট চায়ের দোকানে। তাঁর নাম মো. রাজু। বয়স ৫২। জীবনের পাঁচ-পাঁচটি ব্রেন স্ট্রোকও যাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি।
রাজুর বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী ইউনিয়নে। পিতা মৃত জাফর। গত ৩৪ বছর ধরে রাজশাহীতেই কাটছে তার দিন। বর্তমানে তিনি শহরের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে গার্মেন্টসে। সেখানে একটানা ২৪ বছর কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন ব্রেন স্ট্রোকের শিকার হয়ে হারান তাঁর চাকরি।
“চাকরির জায়গা থেকে আমাকে বের করে দিলো। এত বছর কাজ করেছি, অথচ অসুস্থ হওয়ার পর কেউ রাখার কথাও ভাবল না,” — বলেই থেমে যান রাজু।
চাকরি হারানোর পর ছয়-সাত মাস ঘরেই বসে ছিলেন। কিন্তু সংসার কি আর থেমে থাকে? এক ছেলে, এক মেয়ে—তারা এখন নিজেদের মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত। রাজু থাকেন স্ত্রী আফরোজাকে নিয়ে। সংসার আর নিজের অসুস্থতার বোঝা টেনে জীবনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন জাদুঘর মোড়ে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দিয়ে। দোকানে থাকে রেডিমেড চা, কলা, বিস্কুট, সিগারেট আর পাউরুটি। দৈনিক গড় বিক্রি ৮০০-৯০০ টাকা, যার লাভ থাকে ২০০-২৫০ টাকার মতো। তবে অনেক দিন সেটুকুও হয় না। তবুও নিয়মিত বিকেলে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়েন রাজু। পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসের নাম—স্ত্রী আফরোজা।
রাজু বলেন, “আমি প্রতি মাসে চিকিৎসার পেছনে কমপক্ষে ২৫০০ টাকা খরচ করি। অনেক কষ্ট হয়। তবুও দোকানটা চালিয়ে নিচ্ছি। বয়সের ভার আর অসুস্থতা থাকলেও পরিবারের কথা ভেবেই বসে থাকি না।”
কথা বলতে বলতে চোখে জল জমে তাঁর। বলেন, “আমি কষ্টের কথা কাউকে বলতে চাই না। কেউ যদি শুনেও ফেলে, হাসবে, মজা নেবে। তাই চুপ থাকি।”
আরও পড়ুনঃ ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশে ‘কারবালা’ তৈরি করেছে: উপদেষ্টা ফরিদা আখতার
রাজুর জীবনে নেই আলোঝলমলে কোনো অধ্যায়। নেই কোনো সংস্থার সহায়তা, নেই সরকারি অনুদান কিংবা কোনো প্রভাবশালীর দয়া। কখনো কেউ এসে সহানুভূতির হাত বাড়ায়নি। তবুও তিনি নিজেকে ভাঙা ভাবেন না। তাঁর ভাষায়, “আমি ভাঙিনি, শুধু একটু ক্লান্ত।”
এই ক্লান্ত পথের একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী আফরোজা। দিনের শেষে তিনিই দোকানের পাশে এসে দাঁড়ান, চায়ের কাপ এগিয়ে দেন, দুটো সান্ত্বনার কথা বলেন। রাজুর চোখে জল আসে—কিন্তু সেটা কান্না নয়, বরং কৃতজ্ঞতা। আর হয়তো তা-ই বাঁচিয়ে রাখে তাঁকে, আগামী দিনের জন্য সাহস যোগায় আরেকটা বিকেল যেন এসে হাজির হয়, চায়ের কাপে জমানো গল্পগুলো আবার খুলে বসার জন্য।