spot_img

― Advertisement ―

spot_img
প্রচ্ছদবিশেষ প্রতিবেদনঢাকার উপকন্ঠ শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া যেন " অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য!"

ঢাকার উপকন্ঠ শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া যেন ” অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য!”

মোঃ আসিফুজ্জামান আসিফ, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারঃ ঢাকার উপকণ্ঠের ব্যস্ততম শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া। এ অঞ্চল শুধু পোশাক শিল্পের প্রাণকেন্দ্রই নয়, এটি এখন হয়ে উঠেছে অপরাধের নিরাপদ ঘাঁটি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে আসা মানুষে গিজগিজ করা এই শিল্পাঞ্চলটি বর্তমানে বসবাসরত প্রায় ২০ লাখ মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। খুন, গুলির ঘটনা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি কিংবা মাদকের অবাধ চলাচল— প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো অপরাধে থমকে যাচ্ছে জনজীবন। অথচ অপরাধ ঠেকাতে যেখানে প্রয়োজন পুলিশি তৎপরতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, সেখানে সবই রয়েছে সীমিত ও নড়বড়ে।

চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই আশুলিয়ায় অন্তত ৮টি হত্যা, ৬টি গোলাগুলি, একাধিক ডাকাতি, ছিনতাই এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনায় এখন থানায় কেউ অভিযোগও করেন না। বরং সাধারণ ডায়েরি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে—নিজেকে নিরাপদ রাখতে।

একের পর এক রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডঃ গত ১০ জুন রাতে বগাবাড়ি এলাকায় খোকন মিয়াকে মোবাইল ছিনতাইয়ের সময় ছুরিকাঘাতে হত্যা করে মাসুদ নামে এক ছিনতাইকারী। তার স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে।

২০ এপ্রিল পারিবারিক কলহে স্ত্রী রূপাকে খুন করে তার স্বামী, এরপর লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলারও চেষ্টা চালায়। ৭ মে মাছের ঘের সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে রুবেল মন্ডল নামের এক যুবক খুন হন। ২৬ মে নিজের মা’কে মাদকের টাকা না দেয়ায় কুপিয়ে হত্যা করে এক যুবক। ২ জানুয়ারি মোবাইল নিয়ে দ্বন্দ্বে বন্ধুদের হাতে খুন হন হৃদয়। ৯ মার্চ স্বর্ণপট্টিতে ডাকাতির সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ী দীলিপ কুমার দাসকে কুপিয়ে হত্যা করে ২০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে ডাকাতরা।

গোলাগুলি যেন নিয়মিত চিত্রঃ ২৯ জুন জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ফাঁকা গুলির ঘটনা ঘটে। ৪ জুন জামগড়ায় ঝুট ব্যবসার দখল নিয়ে সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণ হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি অভিনেতা আজাদকে দু’পায়ে গুলি করে পালায় দুর্বৃত্তরা। ৪ ফেব্রুয়ারি বাইপাইলে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে গুলি চালানো হয়। ৯ জানুয়ারি চাঁদা না দেওয়ায় যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে গুলি চালনার অভিযোগ।

ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ভয়াল থাবাঃ ১ মার্চ জিরাবো এলাকার একটি বন্ধ কারখানায় ৩ কোটি টাকার মালামাল লুট করে ডাকাতরা। ৮ মার্চ কবিরপুরে ট্রাক ভর্তি রড ছিনতাই করে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাত দল। ৯ মার্চ স্বর্ণপট্টিতে দোকানে হামলা চালিয়ে স্বর্ণালংকার লুটপাট হয়। এছাড়া প্রতিদিনই ঘটছে ছিনতাই, যার বেশিরভাগই অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ শিবপুরের চেয়ারম্যান হারুন খান হত্যা মামলার আসামি দুবাই থেকে গ্রেপ্তার

অস্ত্র, সন্ত্রাস ও মাদক—সবই উন্মুক্তঃ ১৯ এপ্রিল শীর্ষ সন্ত্রাসী জিয়া দেওয়ানকে গ্রেপ্তার করে তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি জামগড়ায় অভিযান চালিয়ে ৫ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয় অস্ত্রসহ। ৮ মে একটি স্কুল ব্যাগে পাওয়া যায় পিস্তল, হাতবোমা ও রামদা। মাদকের অবাধ হাতবদল চলছে হাত বাড়ালেই—জানান স্থানীয়রা।

আশুলিয়া থানার ওসি আব্দুল হাননান বলেন, “আমরা প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে সক্রিয় রয়েছি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হচ্ছে।”

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির বলেন, “বাংলাদেশে আশুলিয়া একটি ক্রাইম জোন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অপরাধীরা এখানে আশ্রয় নিয়ে অপরাধ করছে। অধিকাংশ অপরাধে আমরা অপরাধীদের ধরতে সক্ষম হয়েছি।”

অপরাধের এমন ধারাবাহিকতা দেখলে মনে হয়, যেন প্রশাসন ব্যর্থ। পুলিশের ঘাটতি, যানজট ও রাস্তাঘাটের দুরবস্থার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দিনের পর দিন হত্যাকাণ্ড, গুলি, লুট, ছিনতাই—সবই যেন চোখের সামনে ঘটে চলেছে। আর প্রশাসন শুধু পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন আশুলিয়ায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর মনিটরিং, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মাদক ও অস্ত্র কারবারের বিরুদ্ধে টাস্কফোর্স গঠন। না হলে এই শিল্পাঞ্চল অচিরেই এক ভয়াবহ অপরাধকেন্দ্রে পরিণত হবে—যার দায় নেবে কে?