
আলোকিত দর্পণ ডেস্ক: পবিত্র ঈদুল আজহার অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য হলো কুরবানি। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সামর্থ্যবান মুসলমানেরা পশু কোরবানি করে থাকেন। তবে এই ইবাদত শুধু পশু জবাই করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—বরং এর অন্তর্নিহিত রয়েছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের মর্মবাণী। তাই কুরবানির গরু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ইসলামে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত ও নিয়ম-কানুন।
বিশেষ করে গরু (বা গবাদিপশু) কোরবানির অন্যতম প্রধান পশু হিসেবে বিবেচিত হয়। সঠিক নিয়ম অনুসরণ না করে পশু কোরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না—এমনটাই হাদীস ও ফিকহবিদদের ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়। তাই কুরবানির পশু, বিশেষ করে গরু কেমন হওয়া উচিত—তা জানা জরুরি।
কোরবানির পশু নির্বাচনের মৌলিক শর্তসমূহ:
১. নির্ধারিত পশু হতে হবে:
ইসলামে কোরবানি দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি পশুকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী—উট, গরু, মহিষ, ছাগল, খাসি ও ভেড়া কোরবানির জন্য বৈধ। গরু কোরবানির ক্ষেত্রে একটি গরু সর্বোচ্চ সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যেতে পারে, তবে সেই সাতজনের সকলের নিয়ত একমাত্র কোরবানি হতে হবে, আকিকা বা মান্নতের উদ্দেশ্যে হলে সেই ভাগে কোরবানি বৈধ হবে না।
২. বয়সের শর্ত:
কোরবানির জন্য গরুর বয়স কমপক্ষে দুই বছর পূর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ কুরবানির দিন পর্যন্ত পশুটি কমপক্ষে দুই বছর বয়সের হতে হবে এবং তৃতীয় বছরে পদার্পণ করতে হবে। একে আরবি ভাষায় বলা হয় “সানি সানাহ”। বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে দাঁতের অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। দুই বছর বয়স হলে গরুর সামনের দু’টি দাঁত পড়ে গিয়ে স্থায়ী দাঁত উঠে আসে। এই বৈশিষ্ট্য দেখে অনেক সময় বয়স নিশ্চিত করা হয়।
৩. শারীরিক ত্রুটি থাকা চলবে না:
ইসলামে কোরবানির পশুর মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক ত্রুটি থাকলে সেই পশু কোরবানি করা বৈধ নয়। যেমন:
- এক চোখ অন্ধ বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
- খুবই দুর্বল ও অস্থি দেখা যায় এমন রুগ্ন গরু।
- এমন গরু যা কানে বড় ধরনের ছিদ্র, কাটা বা ছেঁড়া রয়েছে।
- এমন গরু যার একটি পা অচল বা হেঁটে চলতে অক্ষম।
- লেজ সম্পূর্ণ কাটা কিংবা জন্মগতভাবে লেজবিহীন।
- কানের অর্ধেক বা তার বেশি কাটা হলে কোরবানি জায়েজ হয় না।
হাদীসে এসেছে:
“চার প্রকার পশুর কোরবানি বৈধ নয়—যা এক চোখে অন্ধ ও খোলা চোখেই তা বোঝা যায়, যা অসুস্থ এবং তার অসুস্থতা স্পষ্ট, যা ল্যাংড়া এবং তার ল্যাংড়ামি স্পষ্ট, এবং যা এত রুগ্ন যে তার হাড়ে মজ্জা নেই।” (সুনানে আবু দাউদ: ২৮০২)
৪. অন্য কারও মালিকানা নয়:
কোরবানির পশুটি অবশ্যই কোরবানিদাতার নিজের হতে হবে। চুরি করা, গায়েবি মালিকানার, অন্যের সঙ্গে ঝামেলাপূর্ণ পশু বা ঋণভিত্তিক পশু নিয়ে কোরবানি দেওয়া ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কোরবানির আগ মুহূর্তে কারও কাছ থেকে পশু ক্রয় করা হয়, তবে সেই ব্যক্তি পুরো মূল্য পরিশোধ না করলে এবং ক্রয় সম্পন্ন না হলে কোরবানি জায়েজ হবে না।
৫. সুস্থ ও পরিপুষ্ট গরু নির্বাচন করা উত্তম:
যদিও কোরবানির জন্য প্রাথমিক শর্ত হলো পশুর সুস্থতা ও বৈধতা, তবুও উত্তম হলো—সুন্দর, সুস্থ, মোটা-তাজা এবং মানসম্মত গরু কোরবানি করা। এটি কোরবানিদাতার আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, নিঃস্বার্থতা এবং ত্যাগের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
গরুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে যা যা দেখা উচিত:
- গরুর চোখ উজ্জ্বল ও জীবন্ত হতে হবে।
- গরুর ত্বক চকচকে, পালক অক্ষত এবং পশম ঝরে না যাওয়া।
- মুখে লালা বা কফ না থাকা।
- নাক, কান ও পায়ুপথে কোনো পুঁজ, রক্ত বা অস্বাভাবিক স্রাব না থাকা।
- গরু হাটে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে কি না।
যা জায়েজ কিন্তু পরিহারযোগ্য (মাকরুহ):
- ইসলামে কিছু ত্রুটি রয়েছে, যা কোরবানি অগ্রহণযোগ্য করে না, তবে তা অপছন্দনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন:
- পশুর একটি কান ছোট বা একটু কাটা হলেও তা মাকরুহ, তবে কোরবানি শুদ্ধ হবে।
- জন্মগতভাবে লেজ ছোট হলেও কোরবানি বৈধ, তবে মাকরুহ।
- গর্ভবতী গাভী কোরবানি করা বৈধ, তবে গর্ভের বাচ্চাটিও ভক্ষযোগ্য হবে।
আরও পড়ুনঃ জয়পুরহাটে ঈদের আগে আর টুংটাং নেই কামারপল্লীতে, অলস সময় পার করছেন কামাররা
কোরবানির পশু ক্রয়ের সময় কিছু বাস্তব পরামর্শ:
বিশেষজ্ঞ কাউকে সঙ্গে নেওয়া: পশু নির্বাচনের সময় একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যেমন কৃষি কর্মকর্তা বা পশু চিকিৎসক থাকলে ভালো হয়।
স্বাস্থ্য সনদ বা ভেটেরিনারি ছাড়পত্র দেখা: সরকারি অনুমোদিত পশুর হাটে অনেক সময় পশুর স্বাস্থ্য সনদ দেওয়া হয়—তা যাচাই করে নেওয়া ভালো।
প্রদর্শনী নয়, ইবাদত মনে করে পশু নির্বাচন: শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়—নিয়ত বিশুদ্ধ রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু বাছাই করা সর্বোত্তম।
কোরবানি শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা, ত্যাগ এবং খালিস নিয়তের পরিচয়। তাই কোরবানির পশু নির্বাচনে যেমন শরিয়তের নির্দেশ মানা জরুরি, তেমনি সততা ও বিবেকের অনুসরণ করাও অপরিহার্য। পশুর বাহ্যিক রূপের চেয়েও আল্লাহ তায়ালা আমাদের অন্তরের তাকওয়া ও নিয়তের উপরই মূল্যায়ন করেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছে।” (সূরা হজ: ৩৭)
সুতরাং আসুন, কোরবানির জন্য গরু নির্বাচনের সময় শরিয়তের নির্দেশনাগুলো মেনে চলি, ভুল সিদ্ধান্ত এড়িয়ে পবিত্র ঈদুল আজহাকে একটি সঠিক ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের উৎসবে পরিণত করি।