
একটি দেশ যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ সূর্য দেখার আগেই নিভে যায় তামাকের জ্বলন্ত ছাইয়ে, সেখানে ‘তামাকমুক্ত’ শব্দটি কেবল এক স্বপ্ন নয়,একটি লড়াইয়ের ডাক। ৩১ মে, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আমরা সেই ডাকেই সাড়া দিই। প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে,তামাক কেবল একটি পণ্য নয়, এটি একটি ধ্বংসযজ্ঞ, আর এর পেছনে আছে বহু পরিকল্পিত কূটকৌশল।
বাংলাদেশে তামাকের ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশে তামাকজনিত মৃত্যুর হার বিশ্বে অন্যতম। ২০২১ সালে তামাকের কারণে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১,৩০,০০০ জনের। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১,৬১,০০০ জনর, যা প্রতিদিন গড়ে ৪৪২ জনের মৃত্যু।সময় যত এগোচ্ছে ,এর ভয়াবহতা তত বাড়ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে।
২০২৪ সালের তথ্যে দেখা যায়, দেশের পুরুষদের ৩৪.১% ও নারীদের ০.৪% ধূমপান করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন মোট ২৭.৫% মানুষ। সব মিলিয়ে দেশে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ তামাকের সঙ্গে যুক্ত।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাকজনিত রোগ ও উৎপাদনশীলতার ক্ষতি বাবদ দেশের ৩০৫.৬ বিলিয়ন টাকা ক্ষতি হয়েছে। ২০২৫ সালে এই ক্ষতির পরিমাণ ৪৫০ বিলিয়ন টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
প্রতিদিন যখন কেউ একজন প্রিয় মানুষকে হারাচ্ছেন, তখন হয়তো তারা জানেন না—এই মৃত্যুটি ঠেকানো যেত। তামাকের ছায়ায় ঢাকা এই মৃত্যুর মিছিল যেন আমাদের নীরবতাকেই দায়ী করে।
তামাক কোম্পানির কূটকৌশল: বিষকে ‘পণ্য’ বানানোর ফাঁদ
তামাক কোম্পানিগুলো তরুণদের আকৃষ্ট করতে রঙিন প্যাকেট, স্লিম সিগারেট, মিষ্টি ফ্লেভার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। কৃষকদের তারা প্রলোভন দেখায় সাশ্রয়ী সারের, অথচ জমি হয়ে পড়ে উর্বরতাহীন। নীতিনির্ধারকদের তারা প্রভাবিত করে অর্থনৈতিক অবদানের অজুহাতে। আবার CSR কর্মসূচির নামে স্কুলে অনুদান, গাছ লাগানো বা খেলাধুলায় স্পন্সর দিয়ে নিজেদের ক্ষতিকর ইমেজ ঢেকে রাখে—যা এক ধরণের ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা: প্রাণ বাঁচানোর দায়
তামাক কেবল ফুসফুস নয়, হৃদয়, কিডনি, এমনকি নবজাতক পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবছর হাজারো শিশু জন্ম নিচ্ছে অপুষ্টি নিয়ে, যার এক বড় কারণ গর্ভাবস্থায় মা বা আশেপাশের মানুষ ধূমপায়ী। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বাড়ছে ক্যান্সার, হাঁপানি ও হৃদরোগের ঝুঁকি।
তামাক বনাম উন্নয়ন: বিষের ছায়া
তামাক শিল্প দেশের অর্থনীতিতে অবদান দাবি করে, কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ায়, শ্রমশক্তি কমিয়ে দেয় এবং জমি-জল দূষণ ঘটায়। বাংলাদেশ সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করলেও সিগারেটের ওপর কর এখনো WHO’র ৭৫% সুপারিশের নিচে থাকায় ক্ষতি রোধ করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুনঃ চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরামের নেতৃত্বে মনসুর-মুরাদ
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ: ধোঁয়াবিহীন, প্রাণবন্ত
তামাকের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ কেবল আইন বা সরকারের নয়,এটি একজন সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব। একজন ভোক্তা, একজন শিক্ষক, একজন চিকিৎসক, এমনকি একজন শিক্ষার্থীও এই পরিবর্তনের অংশীদার হতে পারে।
একটি বাংলাদেশ যেখানে শিশুরা খেলবে মুক্ত বাতাসে, যেখানে মা হাসবেন দীর্ঘজীবনের আশায়, যেখানে তরুণেরা স্বপ্ন দেখবে ক্লিয়ার ব্রেইন আর শক্ত হৃদয় নিয়ে,সেই বাংলাদেশ তামাকের ধোঁয়ায় ঢেকে রাখা চলবে না।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসে আমরা কেবল প্রতিজ্ঞা করি না, আমরা সাহসের সঙ্গে বলি
“তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি,
তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।”
লেখকঃ মোঃ মাহমুদুল হাসান
শিক্ষার্থী,গণ বিশ্ববিদ্যালয়