মো: সাদিক ফাওয়াজ সামিন, বুটেক্স প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স)-এ দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকটজনিত সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সমস্যাগুলোর সমাধান না করেই ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন বিভাগ হিসেবে টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু করার ঘোষণা দেওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
নতুন বিভাগ চালুর ঘোষণা অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে আশার সঞ্চার করলেও, ক্লাসরুম এবং শিক্ষক সংকটে জর্জরিত বুটেক্সের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এটিকে ভুল পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উক্ত ঘোষণার পর বুটেক্স ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন নামক একটি ফেসবুক গ্রুপসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন গ্রুপে নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিভিন্ন বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এছাড়াও ক্লাসরুম সংকটের কারণে ক্লাস এবং ল্যাব কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে একই ক্লাসরুমে একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে ক্লাস করতে হয় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ কোর্স সঠিক সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা অভিযোগ করেন।
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. সজিব হাসান জানান, ৪৯তম ব্যাচের প্রায় প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকটের কারণে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে ক্লাস করতে হয়। এতে বসার জায়গা না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে হয়। এছাড়াও শিক্ষক সংকটের কারণে ল্যাবগুলোও ঠিকমতো হয় না, হলেও দুইটি গ্রুপ একসঙ্গে ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করায় আমরা ভালোভাবে শিখতে পারি না। এমতাবস্থায় নতুন ডিপার্টমেন্ট চালু করার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা আমাদের জানা নেই। বুটেক্স প্রশাসনের উচিত বর্তমান মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান নিশ্চিত করে নতুন পরিকল্পনার দিকে অগ্রসর হওয়া।
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. সাহরিয়ার আলম পাবেল বলেন, বুটেক্সে শিক্ষক সংকট অতি পুরাতন একটি সমস্যা। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের কিছু সংখ্যক একই ধরনের কোর্স থাকায় সেগুলো নেওয়ার জন্য প্রচুর সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু সবগুলো ডিপার্টমেন্টেই প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক কম। তার মধ্যে অনেক শিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সেজন্য স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকদের ওপর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চাপ পড়ছে। এমতাবস্থায় যেখানে আগের সমস্যাগুলো সমাধানের বিন্দুমাত্র চেষ্টা কর্তৃপক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না, সেখানে কর্তৃপক্ষ নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলে সমস্যা আরও বাড়িয়ে নিজেদেরকে হাসির পাত্র বানানো ছাড়া আর কিছুই করছে না।
টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান এবং ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মোঃ মামুন কবীর বলেন, বুটেক্সের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৫ টি অনুষদ ও ১৭ টি বিভাগ নিয়ে বুটেক্স আইন-২০১০ অনুমোদিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয় ৫ টি ডিগ্রী অ্যাওয়ার্ডিং বিভাগ নিয়ে। পরবর্তীতে আরও ৫ টি ডিগ্রী অ্যাওয়ার্ডিং বিভাগ যুক্ত করা হয় তার মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছিল এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে নতুন বিভাগ হিসাবে টেক্সটাইল ম্যাটারিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং এর যাত্রা শুরু হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ গবেষণা ও নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা। নতুন নতুন বিভাগ যুক্ত করার মাধ্যমেই গবেষনার পথ অবারিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই নতুন বিভাগটি যুক্ত করা হয়েছে। বিভাগটি চালু করার জন্য ২০২২ সালে ইউজিসি থেকে অনুমোদন নেয়া হয়। প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দক্ষ নেতৃত্বগুনের অভাবে তৎকালীন উপাচার্য বিভাগটি চালু করতে বিলম্ব করেছেন। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. জুলহাস উদ্দিন স্যারের দক্ষ ও স্মার্ট নেতৃত্বে বিভাগটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ।
আরও পড়ুনঃ নালিতাবাড়ীতে বনভোজনে এসে ভোগাই নদীতে ডুবে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু
বুটেক্সে বর্তমানে শিক্ষক সংকট এবং ক্লাস রুম সংকট রয়েছে। এর মধ্যেই নতুন বিভাগ চালু করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাছাড়া শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকট দ্বারা বিভাগটি প্রভাবিত হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বুটেক্সে বর্তমান শিক্ষক সংকটের অন্যতম কারণ অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে আর ফিরছেন না আবার চাকুরি থেকে অব্যাহতিও নিচ্ছেন না। কিন্তু নতুন বিভাগ খোলা হলে ইউজিসি থেকে অনেক শিক্ষক ও অফিসার নিয়োগের অনুমোদন আনা যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ববর্তী যত বিভাগ খোলা হয়েছে সেগুলোর ল্যাব ফ্যাসিলিটি ছিল না পরবর্তীতে ল্যাব সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটির অত্যন্ত উন্নত মানের এবং আধুনিক মেশিনারিজ দ্বারা সমৃদ্ধ ল্যাব রয়েছে। এখানে কিছু মেশিন রয়েছে যা বাংলাদেশের আর কোন ল্যাবে নেই। এই বিভাগটিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ইউজিসি থেকে অনুমোদন রয়েছে সুতরাং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। যেহেতু বিভাগটির ছাত্র সংখ্যা হবে ৪০ জন তাই নতুন একাডেমিক ভবনের একটি ক্লাসরুম ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ল্যাবটিতে পর্যাপ্ত জায়গা থাকায় খুব সহজেই ক্লাস পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এই বিভাগটিতে যে ধরনের কোর্স কারিকুলাম ডিজাইন করা হয়েছে তা অত্যন্ত উন্নতমানের ও বিশ্বের যে কোন উন্নত আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়ালস সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ । আশা করি এই বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীরা পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারদের তীর্থস্থান MIT এর মত প্রতিষ্ঠানে খুব সহজেই মাস্টার্স ও পি. এইচ. ডি তে ভর্তি হতে পারবে।
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, টেক্সটাইল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটি চালু করার জন্য ইউজিসি থেকে আরও ৩ বছর আগে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল এবং একটি প্রকল্পের অধীনে বিভাগটির জন্য প্রায় ২৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল। তবে নানা জটিলতার কারণে এতদিন বিভাগটি চালু করা সম্ভব হয়নি। সব জটিলতা কাটিয়ে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগটি চালু করা হচ্ছে। বিভাগটির জন্য ইউজিসি থেকে ৩ জন প্রভাষক, ১ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ১ জন ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট
নিয়োগের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের জন্য ২ বছর আগেই সার্কুলার দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন খুব শীঘ্রই প্রভাষক এবং ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট নিয়োগের জন্য সার্কুলার প্রদান করবে।
ক্লাসরুম এবং শিক্ষক সংকটের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমাদের নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেটি চালু হলে ক্লাসরুম সংকট দূর হয়ে যাবে। আর ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালার কারণে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা কিছু জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছি। তবে বুটেক্স প্রশাসন খুব শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।