
দীর্ঘদিনের আলোচিত ‘সহানুভূতির নম্বর’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ২৮ পেলে ৩৩ করে পাস করানো কিংবা অপ্রাসঙ্গিক বা ভুল উত্তরের জন্য নম্বর দেওয়ার যে অলিখিত রেওয়াজ ছিল, তা এবার সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হচ্ছে।
শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাই এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নকে বাস্তবভিত্তিক করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে চলতি বছর থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত দেড় দশক ধরে পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নম্বর দিতে উৎসাহিত করা হতো। শিক্ষার্থীরা হাস্যকর ও ভুল উত্তরের জন্যও নম্বর পেতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, “হাজী মুহম্মদ মুহসীনকে কেন দানবীর বলা হয়?”—এই প্রশ্নের উত্তরে এক শিক্ষার্থী লিখেছিল, “তিনি দানব ও বীর ছিলেন, তাই দানবীর বলা হয়।” তবুও উত্তরের জন্য নম্বর দেওয়া হয়েছিল।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, “জিপিএ ৫ পেলেও যদি সে ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারে, তাহলে ফলাফলের কোনো মূল্য থাকে না। আমরা এখন শিক্ষার্থীর প্রকৃত যোগ্যতাকেই মূল্যায়নের ভিত্তি হিসেবে ধরছি।”
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, “উদারতা বা কঠোরতার বদলে আমরা নিরপেক্ষতা ও বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য—অধিক সংখ্যক জিপিএ ৫ নয়, বরং মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরি করা।”
অতীতের মূল্যায়ন ও বিতর্ক
২০০১ সালে চালু হয় গ্রেডিং পদ্ধতি, যেখানে সর্বোচ্চ গ্রেড (এ+/জিপিএ ৫) পাওয়া যায় ৮০-এর বেশি নম্বরে। ২০০৭ সালে চালু হয় ‘স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন (এসবিএ)’ এবং ২০২২ সালে চালু হয় ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ পদ্ধতি, কিন্তু দুর্নীতি ও অকার্যকারিতার কারণে সেগুলো বাতিল হয়ে যায়।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মিঞা মো. নুরুল হক জানান, “শিক্ষকদের আমি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছি—পাসের হার বাড়ানোর জন্য কোনো চাপ নেই। শিক্ষার্থীর প্রাপ্য নম্বরই দিতে হবে। বাস্তবতার ভিত্তিতে খাতা মূল্যায়ন করতে হবে।”
আরও পড়ুনঃ কোতোয়ালী থানার নবনিযুক্ত ওসির নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান, একদিনে গ্রেপ্তার ২৮
পরিসংখ্যানে বোঝা যাচ্ছে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
২০০১ সালে পাসের হার ছিল মাত্র ৩৫.৮১% এবং জিপিএ ৫ পেয়েছিল মাত্র ৭৬ জন। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩.৫৮%-এ, যেখানে জিপিএ ৫ পায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ‘সহানুভূতির নম্বর’ সংস্কৃতিরই প্রতিফলন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রকৃত দক্ষতা, চিন্তাশক্তি ও প্রস্তুতি অনুযায়ী ফল পাবে। এতে তারা ভবিষ্যতের জন্য আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রস্তুত হতে পারবে এবং সার্টিফিকেটের সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানটাই মুখ্য হয়ে উঠবে।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও পরীক্ষকদের দায়বদ্ধতা বজায় রাখা গেলে শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত হবে—এমনটাই প্রত্যাশা শিক্ষাবিদদের।