
গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের বিকল্প নেই। বিশেষত, চলমান জলবায়ু সংকট ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত প্যানেল আলোচনায় এ মন্তব্য করেন বক্তারা।
শুক্রবার (৩ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘এ প্রেস ফর দ্য প্ল্যানেট’ উপজীব্য করে বৃহস্পতিবার (২ মে) ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ইউনেস্কো, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং আর্টিকেল নাইনটিন যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। দিনব্যাপী আয়োজনের দুই পর্বে প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম পর্বে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘বৈশ্বিক চলমান পরিবেশগত সংকটে মুক্ত গণমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্সান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে, বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি ও অফিস প্রধান সুজান ভাইজ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের চেয়ারম্যান রেজওয়ান হক।
প্রথম পর্বের প্যানেল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া) শেখ মনজুর-ই-আলম।
প্যানেল আলোচনায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গত ২০২২ থেকে ২০২৩ সময়কালে পরিবেশ দূষণ নিয়ে প্রতিবেদন করায় গণমাধ্যমের ওপর ২৩টি হামলা হয়েছে। এসব হামলায় ৪৩ জন নির্যাতিত হন। আবার শুধুমাত্র গত ২০১৬ থেকে ২০২১ এর মধ্যে একটিমাত্র কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কমপক্ষে ১২ জন সাধারণ নাগরিক ও পরিবেশ সুরক্ষাকর্মী নিহত হন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আইনগতভাবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, পরিবেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে তাদেরই অনেকে যোগসাজশে লিপ্ত হয়ে অবৈধতাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। এ প্রেক্ষিতে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকা পালন করার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা দরকার। অথচ বাস্তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো বিভিন্ন আইনের নিবর্তনমূলক ধারার অপব্যবহারের মাধ্যমে সেই পরিবেশকেই সংকুচিত করা হচ্ছে। সমালোচনা মাত্রই শত্রুতা, এ মানসিকতার কারণে আইনের অপব্যবহার করে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা গণমাধ্যম ও নাগরিক অধিকারকর্মীদের হয়রানি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় সাংবাদিক ও পরিবেশ সুরক্ষায় নিবেদিত নাগরিক অধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়নকে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে সরকারের দায়িত্বশীল যারা আছেন, তাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতার সাংবিধানিক অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, যেন পরিবেশ সাংবাদিক ও পরিবেশ সুরক্ষায় নিবেদিত নাগরিক সমাজকে ‘শুট দ্য মেসেঞ্জার’ চর্চার হাতে জিম্মি হতে না হয়।’
আরও পড়ুনঃ জয়দেবপুর মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ
সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি ও অফিস প্রধান সুজান ভাইজ বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত সংকট বিষয়ে আমাদের আচরণগত পরিবর্তন আনতে সবাইকে সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম এখনও তথ্যপ্রাপ্তির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। বর্তমান পরিবেশের সংকট নিয়ে সঠিক ও দায়িত্বশীল প্রতিবেদন প্রস্তুতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস-২০২৪ এর লক্ষ্য।’
ঢাকায় নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্সান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবনতির সঙ্গে জনস্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আমাদের সামনে আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে এবং তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফল ও প্রভাব সম্পর্কে মানুষ জানতে চাচ্ছে। এমন সব জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সক্ষমতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।’
আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধে ব্যবহারের নজির রয়েছে। উপাত্ত সুরক্ষা আইনের মতো নানা আইনের খসড়ার বিভিন্ন ধারায় নজরদারির সুযোগ রাখা হয়েছে। যা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ও সাংবাদিকদের হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি করে। এ ধরনের আইনের অপব্যবহার থেকে সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে শেখ মনজুর-ই-আলম প্রতিমন্ত্রীর কাছে জানতে চান।
জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সব সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলি। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে বিশেষ মহলের প্রভাবের কারণে এজেন্ডাভিত্তিক সংবাদও প্রকাশ করা হয়ে থাকে, ভুল তথ্য ও অপতথ্যের প্রচারও হয়ে থাকে। রামপাল বা আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এমন অপপ্রচার আমরা দেখেছি। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ঢাল বানিয়ে কোনো মহলের স্বার্থে ভুল তথ্য বা অপতথ্য প্রচার করলে, আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ। তবে পরিবেশগত সংকট বা জলবায়ু নিয়ে সত্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক সংবাদের জন্য দেশের যেকোনো সাংবাদিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমি যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবো। তাছাড়া, উপাত্ত সুরক্ষা আইন, নজরদারি ইত্যাদি বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনার আগ্রহও প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী।’
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সাংবাদিকতা বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শামসুদ্দিন ইলিয়াস ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক উসরাত ফাহমিদাহ পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ে সাংবাদিকতার সংকট ও সম্ভাবনা বিষয়ে উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রথম পর্বের প্যানেল আলোচনা শুরু হয়।
দিনের দ্বিতীয় পর্বে ‘মিডিয়া ডিফেন্স ফর ক্রাইসিস রিপোর্টিং’ শীর্ষক দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যম ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
ইউনেস্কো নিউ দিল্লী অফিসের অ্যাডভাইজর ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন ফর সাউথ এশিয়া হেজেকিল দলামিনির উদ্বোধনী বক্তব্যের পর আলোচনায় অংশ নেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট সাবিনা ইন্দেরজিত, ইস্ট মোজোর ভারতের মেঘালয়ের রাজ্য প্রতিনিধি প্রিন্সেস গিরি রাশির, জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব ভুটানের বোর্ড অব ডিরেক্টর এর সদস্য সাঙ্গে রাবতেন, ভারতের ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের লিটিগেশন কাউন্সেল রাধিকা রয়, মালদ্বীপ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সদস্য মোহামেদ জুনায়েদ সালিম, শ্রীলঙ্কার মিডিয়া ল ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন বীরাঞ্জানা হেরাথ এবং টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করেন এএফপি এর বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম। এ সময় নিজ নিজ দেশে জলবায়ু ও পরিবেশকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন আলোচকরা।